জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা ভাঙ্গায় অ্যাম্বুলেন্সে বিস্ফোরণে ৮জন নিহত: বাকা সড়কে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো নিহত পরিবারকে চেক বিতরণ, আওয়ামী লীগের নিহতদের বাড়িতে সমবেদনা!
বোয়ালমারী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি : ফরিদপুরের ভাঙ্গায় গত শনিবার (২৪ জুন) দ্রুত গতির অ্যাম্বুলেন্সে আগুন লেগে ৮জন নিহতের ঘটনায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তদন্ত কমিটি। সোমবার বিকেলে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন ফরিদপুর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) বিপুল চন্দ্র দাসসহ ৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি। এদিকে সোমবার সকালে নিহতদের বাড়িতে স্বজনদেরকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সমবেদনা জানাতে যান দলের প্রেসিডিয়াম মেম্বার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান। এছাড়া নিহতদের পরিবারকে জেলা প্রশাসকের ত্রাণ তহবিল থেকে পরিবারে হাতে চেক তুলে দেন বোয়ালমারী উপজেলা চেয়ারম্যান এম এম মোশাররফ হোসেন ও ইউএনও মোশারেফ হোসাইন। এ ঘটনায় হাইওয়ে পুলিশ বাদি হয়ে সোমবার ভাঙ্গা থানায় একটি অপমৃত্যু (ইউডি) মামলা করেছেন। মঙ্গলবার (২৭ জুন) মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভাঙ্গা থানার ওসি মো. জিয়ারুল ইসলাম।
জানা যায়, ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার গুনবহা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ফেলাননগর গ্রামের সৌদি প্রবাসী মো. আজিজার শেখের স্ত্রী তাসলিমা বেগম (৫০) দেড়মাস আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিয়ে মেয়ের বাসায় অবস্থান করছিলেন। তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে সামনে ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে ঢাকার কদমতলী এলাকা থেকে গ্রামের বাড়ি ফেলাননগরের উদ্দেশ্যে তার দুই মেয়ে, চার নাতি-নাতনীসহ ৭ জন গত শনিবার (২৪ জুন) সকালে অ্যাম্বুলেন্সযোগে রওনা হন। পথিমধ্যে বেলা ১১টার দিকে ভাঙ্গা-ঢাকা বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ের ভাঙ্গার মালিগ্রাম ফ্লাইওভারের অ্যাপোস সড়কে অ্যাম্বুলেন্সটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের আয়ারল্যান্ডে সঙ্গে ধাক্কা লেগে গাড়ির ব্যাটারির কানেকশন থেকে গাড়িতে আগুন ধরে যায়। মুহূত্মের মধ্যে গ্যাসের সিলিন্ডারের পাইপ খুলে আগুন ছড়িয়ে পড়লে গাড়িতে থাকা একই পরিবারের ৭ সদস্য পুড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এ দুর্ঘটনায় অ্যাম্বুলেন্সের চালক ফরিদপুর শহরের বাসিন্দা মিতুল মালো (২৪) দরজা ভেঙে সড়কে ছিটকে পড়ে। খবর পেয়ে শিবচর হাইওয়ে থানার পুলিশ ও স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে হতাহতদের উদ্ধার করে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সেখান থেকে মারাত্মক আহত মিতুলমালোকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেলে সেখানে বার্ণ ইউনিটে শনিবার সন্ধ্যায় তিনি মারা যায়। ওইদিন দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী ফরিদপুর জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার ও পুলিশ সুপার মো. শাজাহান এর নির্দেশে হাইওয়ে পুলিশ-ফায়ার সার্ভিস মরদেহ সনাক্তের জন্য ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। নিহতদের ব্যাগে থাকা কাগজপত্র পর্যলোচনা করে জেলা প্রশাসন জানতে পারেন নিহতদের বাড়ি বোয়ালমারী উপজেলার গুনবহা ইউনিয়নের ফেলাননগর গ্রামে। ডিসি-এসপি সংর্শ্লিষ্ট উপজেলার ইউএনও এবং ওসিকে বিষয়টি জানান। পরবর্তীতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় নিহত তাসলিমা বেগমের বাড়িতে দুপুর ৩টার দিকে এ খবর পৌচ্ছালে স্বজনদের কান্নায় ভারী হতে থাকে ফেলাননগর, মাইটকুমরা ও কুচিয়াগ্রাম। বুধবার দিবাগত রাত ৯টায় জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে নিহত তাসলিমা বেগমের মরদেহ ফেলাননগর, তার বড় মেয়ে শেখর ইউনিয়নের মাইটকুমড়া গ্রামের আলমগীর খানের স্ত্রী কমলা পারভীন (৩২), কমলা পারভীনের বড় ছেলে আরিফ (১৩), মেঝ ছেলে হাসিব (৮) ও কন্যা আফসার (২) লাশ রাত সাড়ে ১০টায় মাইটকুমরা গ্রামে এবং নিহত তাসলিমার মেঝ মেয়ে পাশ্ববর্তী উপজেলা আলফাডাঙ্গার গোপালপুর ইউনিয়নের কুচিয়াগ্রামের সেনা সদস্য মাহামুদুল হাসান রনির স্ত্রী মোসা. বিউটি পারভীন (২৭), বিউটি পারভীনের ছেলে মেহেদীর (১০) মরদেহ নিজবাড়ি কুচিয়াগ্রামে জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়। অ্যাম্বুলেন্সের চালক মিতুল মালোর মরদেহ রবিবার (২৫জুন) ফরিদপুর পৌর মহাশ্বশানে দাহ করা হয়েছে। এ ঘটনায় ফরিদপুর জেলা প্রশাসন শনিবার রাতেই ফরিদপুর অতিরিক্ত জেলা (এডিএম) বিপুল চন্দ্র দাসকে প্রধান করে ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। রবিবার দুপুরে তদন্ত কমিটি ৮জন নিহতের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সোমবার প্রতিবেদন জমা দেন। এ ঘটনায় হাইওয়ে পুলিশের উপপরিদর্শক জয়ন্ত সরকার বাদি হয়ে সোমবার ভাঙ্গা থানায় একটি অপমৃত্যু (ইউডি) মামলা করেছেন। এদিকে সোমবার বেলা ১১টায় নিহতদের বাড়িতে স্বজনদেরকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সমবেদনা জানাতে নিহতদের বাড়িতে ছুটে যান দলের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান। এছাড়া নিহতদের পরিবারকে জেলা প্রশাসকের ত্রাণ তহবিল থেকে নিহতদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে চেক তুলে দেন বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোশারেফ হোসাইন, উপজেলা চেয়ারম্যান এম এম মোশাররফ হোসেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান প্রমূখ। চেক গ্রহণ করেন আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া তাসলিমা বেগমের ছেলে আনিস শেখ, তাসলিমা বেগমের মেয়ে নিহত কমলা বেগমের স্বামী আলমগীর খান ও বিউটি বেগমের স্বামী মাহমুদুল হাসান রনি। এর আগে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে নিহতদের দাফনের জন্য ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে ভাঙ্গা থানার ওসি মো. জিয়ারুল ইসলাম জানান, নিহতদের পরিবার থেকে কোন অভিযোগ না পাওয়ায় শিবচর হাইওয়ে থানা পুলিশ বাদি হয়ে ৮জন নিহতের ঘটনায় থানায় সোমবার ইউডি মামলা করেছেন। মঙ্গলবার অ্যাম্বুলেন্সে আগুন লেগে পুড়ে ৮জন নিহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রধান ফরিদপুর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিপুল চন্দ্র দাস জানান, অ্যাম্বলেন্সটির ২০২৩ সালের ফিটনেস সনদের মেয়াদ ও চালকের কাগজপত্র সবই ঠিকঠাক ছিল। আকাবাকা সড়কে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানোই ছিল দূর্ঘটনার মূল কারণ। তিনি জানান, অ্যাম্বুলেন্সটির বাম পাশের টায়ার বাস্ট হয়ে বামে-ডানের এক্সপ্রেসওয়ের আয়ারল্যাল্ডে ধাক্কা খেয়ে গাড়িটি সোজা হয়ে সামনে গিয়ে রাস্তার ওপর আড়াআড়ি ভাবে দাড়িয়ে পড়লে ইঞ্জিনের ব্যাটারি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে গ্যাসের সিলিন্ডারের পাইপ লিকেজ হয়ে গ্যাস বের হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়লে গাড়িতে থাকা সকলেই পুড়ে মারা যায়। সোমবার এ ব্যাপারে তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।