রাজশাহী ব্যুরো মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করাসহ আত্মহত্যা করার মত অকথ্য ভাষায় লাঞ্চিত হয়েছেন পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশল (সিএমই) বিভাগের এক নারী। এমন ঘৃন্য অভিযোগ উঠেছে পশ্চিমাঞ্চল রেলের চীফ অপারেটিং সুপারিন্টেন্ডেন্ট বিভাগের ডেপুটি সিঅপিএস হাসিনা খাতুনের বিরুদ্ধে। তার (হাসিনা খাতুন) হিংসার ছোবলে আত্মহত্যার মত ঘৃনিত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন সেই নারী। এমন অভিযোগ তুলে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভুক্তভোগী পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশল (সিএমই) বিভাগের ট্রেসার রোবানা ফেরদৌস ও পিতা আ: রহমান।
উল্লেখ্য, গত ৩০ অক্টোবর আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে ১৬ টি ঘুমের ঔষধ সেবন করে অচেতন হয়ে পড়েন সেই নারী। এরপর তাকে বাঁচাতে দ্রুত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসেন তিনি। পরে বেঁচে ফেরা সেই নারী পরিবারকে জানায়, গত ৭ মে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার তদন্ত করছিলেন ডেপুটি সিঅপিএস হাসিনা খাতুন। সেই তদন্তের অংশ হিসেবে গত ৩০ অক্টোবর তাকে জিজ্ঞেসাবাদের জন্য ডাকা হয়। জিজ্ঞেসাবাদের সময় তাকে অকথ্য ভাষা ব্যবহার করেন হাসিনা খাতুন। কথাগুলো সহ্য করতে না পেরে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। এই বিষয় নিয়ে কাঁনাঘোঁষা শুরু হলে তথ্য অনুসন্ধান শুরু করে মিডিয়াকর্মীরা। এতে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে মিডিয়ার অনুসন্ধানে।
জানা যায়, দীর্ঘদিন থেকে ভুক্তভোগী এই নারী যৌন হয়রানির চেষ্টা করতো একই দপ্তরের ফেরো প্রিন্টার খালেক সিকদার। মান সম্মানের ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারতেন না তিনি। অবশেষ গত ৭ মে অফিস ছুটির সময় অর্থাৎ বিকাল পৌনর চারটার দিকে ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হন। এতে চরম মানষিক ও শারিরীকভাবে ভেঙে পড়ে ভুক্তভোগী ঐ নারী। এমন ঘটনার বিচার চেয়ে অভিযোগ জানাতে যায় দপ্তর প্রধান অর্থাৎ প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী কুদরত-ই- খুদা এর নিকট। কিন্তু ঘটনার সুষ্ট বিচার সমাধানের আশ্বাস দেন যন্ত্র প্রকৌশলী (সদর) ফজলে রব। পরের দিন ভিক্টিম ও অভিযুক্ত খালেক সিকদারকে ডেকে জিজ্ঞেসাবাদ করেন ফজলে রব।
এসময় ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন এবং পাঁ ধরে ক্ষমা চান খালেক সিকদার। এমন ঘটনায় চরম ক্ষিপ্ত হন এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের কথা বলেন ফজলে রব। পরবর্তীতে মামলার সিদ্ধান্ত নিলে নানাভাবে বাধাগ্রস্থ করেন খালেক সিকদার। অবশেষে পরিবারের সাথে আলোচনা করে গত ২০ জুন আরএমপির চদ্রিমা থানায় ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১০ ধারায় একটি নিয়মিত মামলা করেন ভুক্তভোগী সেই নারী।
এরপর ২৬ তারিখে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিভাগীয় তদন্ত জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। সেই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা ডেপুটি সিঅপিএস হাসিনা খাতুনকে। বাঁকী দুই সদস্য হলেন এজিএম মেহেদী হাসান ও এম ই (সদর) ফজলে রব। কিন্তু হাসিনা খাতুন সেই তদন্তে গড়িমশি করলে আরও মানষিকভাবে ভেঙে পড়ে ভুক্তভোগী নারী। এব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তদন্তকারি সদস্যদের মধ্যে চলছে চরম সমন্বয়হীনতা। যা তদন্ত প্রতিবেদন সন্ধিহান হয়ে পড়ে। তদন্ত প্রতিবেদন বিভ্রান্তকর হতে পারে ভেবে ভুক্তভোগীর ভাই মোস্তাফিজুর রহমান পশ্চিমাঞ্চল রেলের মহাব্যবস্থাপক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দেন। তাতেও থামানো যায়নি অসত্য তদন্ত প্রতিবেদন।
অবশেষে নভেম্বরের মাঝামাঝি তদন্ত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ফজলে রবে এর সাক্ষর ছাড়াই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন হাসিনা খাতুন। তদন্ত প্রতিবেদনে হাসিনা খাতুন তার মনগড়া অসত্য তথ্য তুলেছেন ধরেছেন এবং খালেক সিকদারকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
এই ঘটনায় ভুক্তভোগী ঐ নারীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, হাসিনা স্যার, তদন্তের শুরু থেকে আমাকে নানাভাবে হয়রারি করার চেষ্টা করেছেন। তিনি আমাকে মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করতেন। তিনি সরাসরি বলেছেন, তার কথা না শুনলে, তিনি আমার বিপক্ষে রিপোর্ট দিবেন। গত ৩০ অক্টোবর আমাকে খুব আজেবাজে কথা বলেছেন যা আমি শুনতে প্রস্তুত ছিলাম না।
আপনার উপর তার রাগ হওয়ার কারন কি? জানতে চাইলে তিনি জানান ২০১৭ সালের আমার ছোট ভাইকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন হাসিনা স্যার। কিন্তু সেই বিয়েটি আমি সরাসরি প্রত্যাখান করি। এটাই আমার অপরাধ। তদন্ত চলাকালীন তিনি আমাকে বলেছেন, সে নাকি আমার ব্যক্তি লাইফ নিয়ে গভীর তদন্ত করছেন। তবে আমার মত অনেক নারী রেলওয়েতে বিভিন্ন পদে চাকরি করেন। আমি চাই, আমার মত কেউ যেন এমন ঘটনার শিকার না হয়! আমার চাওয়া, এই ধরনের দুঃচরিত্র লোককে চাকরিচ্যুত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
এমন অভিযোগের ব্যাপারে পশ্চিমাঞ্চল রেলের ডেপুটি চীফ অপারেটিং সুপারিন্টেন্ডেন্ট (সিঅপিএস) হাসিনা খাতুনের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আপনাদের নিকট যে অভিযোগ দেয়া হয়েছে সেটি মিথ্যা। আপনি ঘটনার তদন্ত না করে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তদন্ত করেছেন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন এটিও তদন্তের অংশ ছিল। এসময় তার (হাসিনা খাতুন) ফোনে থাকা সেই ভুক্তভোগী নারীর নানা ঘটনার বিবরণ শোনান সাংবাদিকদের। এগুলো তো মানুষের মুখের কথা শুনেছেন, আপনি কি তাদের থেকে প্রমান পেয়েছেন? সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে তিনি জানান, না, আমার শোনা কথা।
আপনি অভিযুক্ত খালেক সিকদারের ব্যাপারে কি কি তথ্য পেয়েছেন? তার স্ত্রী কয়টা, তিনি এই দপ্তরে এর আগে কি কি করেছেন, তার বিরুদ্ধে কোন মামলা আছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে তেমন কোন তথ্য পাইনি।এসময় সাংবাদিকদের কাছে থাকা বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করলে তিনি বলেন, এগুলো আমার জানা ছিলনা। যেখানে পুলিশের চার্জশিটে খালেক সিকদারের সেই ঘটনাটি সত্য বলা হয়েছে সেখানে আপনি কেন ঘটনাটি ভিত্তিহীন মনে হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আমি তেমন জোরালো সাক্ষী প্রমান পাইনি। তবে আমার তদন্তে যদি সন্ধিহান থাকে তাহলে পুনরায় তদন্ত করার সুযোগ রয়েছে।
পরে এবিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মামুনুল ইসলাম, পিইঞ্জঃ এর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমি মাত্র কিছুদিন হলো এখানে যোগদান করেছি তাই তেমন কিছু জানা নাই। এই ঘটনাটি অনেক আগের । এ ঘটনায় আমার কাছে একটি অপুর্নাঙ্গ প্রতিবেদন এসেছে। প্রতিবেদনটি যদি পক্ষপাতমুলক হয় তাহলে আবার নতুন কমিটি করে, নতুনভাবে তদন্ত করা হবে। এমন ঘটনা সত্য হলে পুরো রেল ডিপার্টমেন্টের দুর্নাম। তবে এই ঘটনায়, সর্বপ্রথম উচিৎ ছিল অভিযুক্তকে বদলী করে দেওয়া। কিন্তু সেটি করা হয়নি। তবে খালেক সিকদার সাময়িকভাবে বরখাস্ত রয়েছে। ডেপুটি সিঅপিএস হাসিনা খাতুনের সাথে ভুক্তভোগী নারীর ভাইয়ের সাথে বিয়ে না হওয়ার কথার ব্যাপারে জানেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে জানার আগ্রহ নাই। যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে উনাকে তদন্ত কমিটিতে দেয়া ঠিক হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটির সাথে বসবো কেন নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা হলো জবাব চাইবো। তবে সঠিকভাবে তদন্ত করে যদি ঘটনার প্রমান মেলে তাহলে প্রচলিত আইনানুযায়ী খালেক সিকদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে নিশ্চিত থাকেন।