ডেইলী নিউজ বাংলা ডেস্ক , আপলোডের সময় : মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০২২ , আজকের সময় : শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

বাণিজ্যের নতুন দুয়ার খুলে দিল পদ্মা সেতু।

  কাজি  মোস্তফা রুমি, স্টাফ রিপোর্টার : পদ্মা সেতু বদলে দিতে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্র। বাড়বে বাণিজ্য ও রপ্তানি। তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থান। বদলে যাবে মানুষের জীবনযাত্রার মান। সেতুর উপর দিয়ে যাচ্ছে গ্যাসের পাইপলাইন, যা দিয়ে গ্যাস পৌঁছাবে এই জনপদসহ আশপাশের অনেক জেলায়।
পদ্মা সেতু ঘিরে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের কাজের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে চলাচল করছে যানবাহন। আর এতেই বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনজুড়ে বইছে সুবাতাস। সুন্দরবনে এবার সরাসরি সড়ক পথেই যাওয়া যাবে। এতে সুন্দরবনে পর্যটকের সঙ্গে রাজস্ব আয় বাড়বে ৪-৫ গুণ। নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন এ জনপদের সাধারণ মানুষ।
ইতোমধ্যে সেতুকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলা, বিশেষ করে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরে দেখা দিয়েছে পরিবর্তনের সূচনা। এ সেতুকে ঘিরে সম্ভাবনার আরেক বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে।
উন্নয়নের উন্মাদনা চলছে সেতুসংশ্লিষ্ট এলাকায়। এসব এলাকায় জমির দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি বাড়ছে নানা ধরনের স্থাপনা। বর্তমানে এক বিঘা জমির দাম স্থানভেদে ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অনেকে শিল্প-প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি কিনে রেখেছেন। স্থানীয়রাও নানামুখী ব্যবসার উদ্যোগ নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান বলেন, পদ্মা পাড়ি দিতে ফেরিঘাটে ট্রাককে সাধারণত আগে পাঁচ-সাত ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হতো। মাঝেমধ্যে দুই থেকে তিন দিন লাগত।
তিনি আরও বলেন, অপেক্ষা মানেই চালক-সহকারীর বাড়তি খরচ। পণ্য ও মালিকের ক্ষতি। এখন ৬ মিনিটে পদ্মা নদী পার হওয়া যাচ্ছে। পরিবহন খাতের মানুষ হিসেবে এটা বড় পাওয়া। আর ‘পদ্মা সেতু’ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য এক আশীর্বাদ।
ঢাকার সঙ্গে মাওয়া হয়ে বরিশালের দূরত্ব ১৬০ কিলোমিটারের মতো; কিন্তু সেখান থেকে কোনো কৃষিপণ্য নিয়ে রওনা দিলে পদ্মা পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। নদীটি পাড়ি দিতে কত সময় লাগবে, তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। স্রোত বেশি হলে ফেরি বন্ধ থাকত, শীতের দিনে কুয়াশায় ফেরি বন্ধ থাকত, নদীর নাব্যতা সংকটে ফেরি চলাচলে বিঘ্ন ঘটত। ওই অঞ্চলে ঢাকাকে কেন্দ্র করে তেমন কোনো বাণিজ্য গড়ে ওঠেনি। এখন সব বাধা কেটে গেছে।
পদ্মার যোগাযোগ ব্যবস্থা কেবল দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে সারাবিশ্বে। বিশেষ করে এশিয়ান হাইওয়ের যে স্বপ্ন দেখছে এশিয়াভুক্ত দেশগুলো, তাদের স্বপ্নের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার এখন পদ্মা সেতু। সে কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সঙ্গে এশিয়ান হাইওয়ে সম্পর্কিত একটি গ্রুপে যুক্ত হয়। এই মহাসড়কের মাধ্যমে এশিয়ার ৩২টি দেশের সঙ্গে আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সুগম হবে, তৈরি হবে ১ লাখ ৪৫ হাজার কিলোমিটারের বিশাল সড়কপথ। এই সড়কপথের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রুট যাবে বাংলাদেশের উপর দিয়ে। এশিয়ান হাইওয়ে-১, এশিয়ান হাইওয়ে-২ ও এশিয়ান হাইওয়ে-৪১ রুটের ১ হাজার ৭৭১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বিশাল সড়কপথটির অবস্থান হবে বাংলাদেশের মানচিত্রে। এশিয়ান হাইওয়ে-১-এর রুট হচ্ছে ভারতের আসাম হয়ে সিলেট, ঢাকা, নড়াইল, যশোর ও সবশেষে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। এই পথে সেতু হয়ে যাওয়ায় এক মহাসড়কে দ্রুততম সময়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে যাতায়াত করা যাবে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এই হাইওয়ের রুটে বাংলাদেশ থেকে সড়কপথে সিঙ্গাপুর ও ইউরোপে যাওয়া যাবে। এশিয়ার রেলপথের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের স্বপ্নও পূরণ হচ্ছে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে। এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হলে এশিয়ার ২৮টি দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আব্দুল কাদের বলেন, অনেকগুলো বছর সেতুর নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত আমি। এর প্রতিটি সিমেন্ট-বালুকণার সঙ্গে শ্রম-ঘাম মিশে রয়েছে। গত কয়েকটি বছর আমাদের সব কাজকর্মই ছিল এই সেতুকে ঘিরে।
জানা গেছে, এখানেই গড়ে উঠছে তাঁত পল্লি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা মৌজায় ৫৯ দশমিক ৭৩ একর ও মাদারীপুর জেলার শিবচরের কুতুবপুর মৌজায় ৬০ একর করে ১১৯ দশমিক ৭৩ একর জমিতে নির্মাণ হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় ‘শেখ হাসিনা তাঁত পল্লি’।
স্থানীয়দের জীবনমান উন্নয়নেই সরকারের এসব উদ্যোগ। প্রকল্পের আওতায় ৮ হাজার ৬৪টি তাঁত শেড নির্মাণ করা হবে। যেখানে ৮ হাজার ৬৪ তাঁতি পাবেন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। এর বার্ষিক উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৪ দশমিক ৩১ কোটি মিটার কাপড়।
এর বাইরেও মাদারীপুরের শিবচর, শরীয়তপুরের জাজিরা, নড়িয়া ও ফরিদপুরের ভাঙ্গাসহ বিভিন্ন উপজেলায় বড় বড় শিল্প গ্রুপ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য জমি কিনে রেখেছেন। অনেক স্থানে তৈরি হচ্ছে পার্ক-রিসোর্ট। নদীভাঙন ঠেকাতেও নড়িয়া, জাজিরা, শিবচরসহ বিভিন্ন এলাকায় নেওয়া হয়েছে নানা প্রকল্প। ইতোমধ্যে নড়িয়ায় তৈরি হওয়া বেড়িবাঁধে পর্যটকরাও যাচ্ছেন নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে। শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলায় তৈরি হচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। সেতুর ওপারে হচ্ছে শেখ হাসিনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শেখ রাসেল শিশু পার্ক, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব নার্সিং ইনস্টিটিউট অ্যান্ড কলেজ, আইএইচটি ভবন, ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, শিল্পকলা একাডেমি ভবন, মুক্তমঞ্চ ও অলিম্পিক ভিলেজ।
পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে পায়রা সামুদ্রিক বন্দর নির্মাণ প্রকল্প শেষের দিকে। উৎপাদন শুরু করেছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। সরকারের এই দুই প্রকল্প ঘিরে পটুয়াখালীর কলাপাড়া এখন অর্থনেতিক সমৃদ্ধি অর্জনকারী উপজেলা। পদ্মা সেতুর রেললাইন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের রেললাইন যাবে পায়রা বন্দর পর্যন্ত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, শুরুর দিকের ফিজিবিলিটি স্টাডি অনুসারে এই সেতু জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ অবদান রাখবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে ওটা প্রায় দুই শতাংশ হবে।
জানা গেছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন সড়কপথে দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে খুলনার কয়রা ও দাকোপ, বাগেরহাটের মোংলা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা হয়ে সরাসরি যাওয়া যাবে সুন্দরবনে। এটি ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিষয়। ফলে ভ্রমণ মৌসুমে সুন্দরবনে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়বে। সমৃদ্ধ হবে সুন্দরবন বিভাগের অর্থনীতি।
পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয়, দৃষ্টিনন্দন ও আনন্দদায়ক করে তুলেছে মুন্সীগঞ্জ এলাকায় গড়ে ওঠা আকাশলীনা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার, মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত, কলাগাছিয়া ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার, দোবেকী ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার, ক্যারাম মুরা ম্যানগ্রোভ ভিলেজ, ক্যারাম মুরা পাখি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, কৈখালী সীমান্ত ও পাঁচ নদীর মোহনা, উড়ালমন আদিবাসী গ্রাম ও নৌকা ভ্রমণ সাইট এবং শিয়ালকুনি বনায়ন।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এম এ হাসান জানান, সুন্দরবন একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। পর্যটকদের কাছে সুন্দরবন খুবই আকর্ষণীয়। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন ঢাকা থেকে সকালে এসে সুন্দরবন ঘুরে বিকেলে চলে যেতে পারবেন পর্যটকরা। এখানে পর্যটকদের জন্য সুন্দরবন ঘোরার সব ধরনের সুযোগ সুবিধা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আপাতত তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশের পাস বন্ধ রয়েছে। কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে মৌসুমের আগেই পাস ইস্যু শুরু হবে।
২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রায় তিন কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সাতক্ষীরা রেঞ্জের সুন্দরবনে পর্যটকের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। রাজস্ব আদায়ও বেড়ে দ্বিগুণ হবে। তবে ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে সুন্দরবনে পর্যটক এসেছে এক লাখ ২০ হাজার জন। এখান থেকে সুন্দরবন বিভাগের রাজস্ব আয় হয়েছে এক কোটি ২৫ লাখ টাকা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সুন্দরবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। পর্যটকদের সংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমনি রাজস্বও বাড়বে বলে এই বন কর্মকর্তা জানান।
সুন্দরবনের ট্যুরিজম ব্যবসায়ীদের নেতা নাজমুল আযম ডেভিড বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় অধিকাংশ সময় পর্যটকরা সুন্দরবনে আসতে চাইত না। এখন যেহেতু পদ্মা সেতু চালু হয়েছে, তাই সেই চিরচেনা চিত্র একেবারেই পাল্টে যাবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার দূরত্ব কমে সহজ হওয়ায় এখন পর্যটকদের আকর্ষণও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।