কাজী মোস্তফা রুমি, স্টাফ রিপোর্টার: টাঙ্গাইলে লাল মাটির উঁচু-নিচু পাহাড় আর ছোট ছোট বাইদ(নিচু আবাদি জমি) নানা গাছ-গাছরায় সজ্জিত মধুপুর বনাঞ্চল। এ বনে এক সময় নানা বৃক্ষরাজির সমাহার ছিল, ছিল না ভেষজ উদ্ভিদেরও কোন অভাব। ছিল বন্য প্রাণিদের অবয়ারন্য।
দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বনের কাঠ পাচারের সাথে পাল্লা দিয়ে ভেষজ গাছ-গাছরাও হারিয়ে যেতে থাকে। ফলে বন বিভাগ ভেষজ বাগান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। বন বিভাগের মালবিকা ভেষজ উদ্যানের সুফল এখন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঘরে ঘরে।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে- শাল, গজারী, সেগুন, বহেরা, গাদিলা, গামারী, পিতরাজ, বানরনরী, কানাইডিঙ্গা, আমলকি, আনাইগোটা, ভাটি ফুল সহ ভেষজ উদ্ভিদে ভরপুর ছিল মধুপুর বনাঞ্চল। পাহাড়ে বসবাসরত নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী গারোদের হরেক রকম খাবারের বৈচিত্র্য ছিল এ বনের ভেষজ উদ্ভিদ। গারো সম্প্রদায়ের লোকেরা বনের গহীন থেকে বড় বড় গাছের মাঝখানে গজিয়ে ওঠা পাহাড়ি আলু সংগ্রহ করে খাদ্যের জোগান পেত।
দেশ-বিদেশের কবিরাজরা এ বন থেকে নানা ভেষজ উদ্ভিদ সংগ্রহ করে রোগীর সেবা করত। বনের ভেষজ উদ্ভিদই এতদাঞ্চলের মানুষের রোগমুক্তির একমাত্র মাধ্যম ছিল। যুগ যুগ ধরে পাহাড়ে বসবাসরত মানুষরা আধুনিক চিকিৎসা সেবা পৌঁছার আগে ভেষজ চিকিৎসা নিয়ে সুস্থতা লাভ করত। কালের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে বনের গাছ-গাছালি নিধন করে বসতি গড়ার ফলে বন সঙ্কুচিত হতে থাকে। একই কারণের পাশাপাশি কতিপয় কবিরাজ ভেষজ উদ্ভিদ গোড়াসহ উঠিয়ে নিতে থাকায় কমতে থাকে ভেষজ উদ্ভিদ।
ভেষজ চিকিৎসা জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে মধুপুর বনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ভেষজ বৃক্ষাদি ব্যতিত ভেষজ চিকিৎসা ও ভেষজ ওষুধ তৈরি অসম্ভব। পাহাড়ের নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভেষজ চিকিৎসার দিকে খেয়াল রেখে টাঙ্গাইল বন বিভাগ মধুপুরের বিলুপ্ত প্রায় ভেষজ উদ্ভিদের বাগান সৃজন করেছে। ওই বাগানের সুফল পেতে শুরু করেছে পাহাড়ি মানুষ।
টাঙ্গাইল বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মধুপুর গড়াঞ্চলে বসবাসরত উপজাতি জনগোষ্ঠীর ভেষজ চিকিৎসার যোগান দিতে ভেষজ উদ্ভিদের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য ২০০৩ সালের ৪ জুলাই মধুপুরের চাড়ালজানী রেঞ্জের বেরীবাইদ মৌজার জলছত্র এলাকায় ভেষজ উদ্যান করা হয়। চাড়ালজানী রেঞ্জের আয়তন ৫৮৮০.৪৬ হেক্টর। প্রাকৃতিক, সামাজিক, ভেষজ উদ্যান ছাড়াও বেত, বাঁশ, উডলট, আগর ও শাল কপিস এ রেঞ্জের অন্যতম গাছ।
টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে গড়ে তোলা ওই বাগানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মালবিকা’ ভেষজ উদ্যান। উদ্যানে ২০০২-২০০৩ অর্থ বছরে তিন হেক্টর জমিতে ভেষজ উদ্ভিদ চাষ করা হয়। উদ্যানের গাছ বৃদ্ধি ও গাছের অবস্থা ভাল হওয়ায় ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে আয়তন বাড়িয়ে চার হেক্টর জমিতে ভেষজ গাছ লাগানো হয়। এ ভাবে ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে ছয় হেক্টর ও ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে সাত হেক্টর জমিতে ভেষজ বাগান করা হয়। সব মিলিয়ে মালবিকা ভেষজ উদ্যানে ২০ হেক্টর জমিতে ভেষজ গাছ-গাছরার বাগান গড়ে তোলা হয়েছে।
মালবিকা ভেষজ উদ্যানের গাছ-গাছরার মধ্যে রয়েছে- আমলকি, হরিতকি, বহেরা, নিম, অর্জুন, নিশিন্দা, মহুয়া, নাগেশ্বর, উলুটকম্বল , বকুল, সোনালু, চন্দন, আগর, আমড়া, জলপাই, খাড়াজড়া, পিতরাজ, পেয়ারা, জাম, তেতুল, বেল, কালমেঘ, বাসক, হাতিশুর, চম্পাফুল, পিপুল, আকন্দ, ঘৃতকাঞ্চন, কেউকলা, মেহেদী, নয়নতারা,শতমূল, চাপালিশ, অশোক, শেফালী, চালতা, সর্পগন্ধা, পাথরকুচি, তুলসি, ধুতুরা, তেজপাতা, জাম্বুরা, ঢাকি জাম, কুম্বি, ঢেউয়া, গর্জন, হৈমন্তী, কন্যারী, পুত্রঞ্জীব, গোলাপ জাম, দুধকচু, আতা, কদবেল, কামরাঙ্গা, বার্মাশিমূল, লটকন, কালেন্ড্রা, সিভিট, কানাইডিঙ্গা, পান, খয়ের, অনন্তমূল, গন্ধাসাগর, আগুনসর, নীলমনি, অড়হড় প্রভৃতি।
এ অর্থবছরে সৃজিত ভেষজ বাগান পরিপক্ক বাগানে রূপ নিয়েছে। উদ্যানের ভেষজ গাছের সুফল পাহাড়ি জনগোষ্ঠী পেতে শুরু করেছে বলে বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানিয়েছে।
সরজমিনে চাড়ালজানি রেঞ্জের জলছত্র এলাকার মালবিকা ভেষজ উদ্যানে গিয়ে দেখা যায়, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়কের পূর্ব পাশে ‘মালবিকা’ ভেষজ উদ্যানের অবস্থান। উদ্যানে নানা নাম ও জাতের ভেষজ উদ্ভিদে ভরপুর। হরেক প্রজাতির ভেষজের কারণে উদ্যানে গুনাগুণ ও সৌন্দর্য্য অনেকাংশে বেড়েছে।
দেখে মনে হয়- কেউ সবুজের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। সে এক মনলোভা দৃশ্য। আগে লাগানো ভেষজ চারাগুলো বড় হয়ে বৃক্ষে রূপ নিয়েছে। বৃক্ষগুলো ফুল-ফল দেওয়া শুরু করেছে। উদ্যানে প্লট আকারে প্রজাতি ভেদে বাগানের বিন্যাস করা হয়েছে। ফলে স্থানীয়রা প্রয়োজনীয় গাছটি সহজেই হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ও বাঙালিরা জানায়, বন বিভাগের মালবিকা উদ্যানের ফুল-ফল, লতা-পাতা, ছাল-বাকল ইত্যাদি সংগ্রহ করে তারা কবিরাজি ওষুধ তৈরি করে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। এছাড়া আশপাশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ ওই বাগানের সুবিধা নিতে ছুটে আসছে। কেউ কেউ আবার বীজ সংগ্রহ করে জাত সংরক্ষণ করছে। নিজেদের আঙিনায় চাষ করে সুবিধা পাচ্ছেন।
টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুজ্জামান জানান, ভেষজ ওষুধ তৈরিতে গাছ-গাছরার কোন বিকল্প এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। কবিরাজদের জন্য ভেষজ উদ্যান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভেষজ চিকিৎসায় কোন পাশর্^প্রতিক্রিয়া নেই। বিষমুক্ত ও প্রাকৃতিকভাবে মধুপুরে সৃজিত ‘মালবিকা’ ভেষজ উদ্যানে চাষ করা হয়।
ওই বাগানের সুবিধা নিয়ে স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালিরা উপকৃত হচ্ছে। এ বাগান সংরক্ষিত থাকলে যুগ যুগ ধরে এ এলাকার মানুষেরা এর সুফল পাবে। ভেষজ বাগানের গুনাগুন আবহাওয়ার সাথে মিশে স্বাস্থ্যের জন্য উপকার বয়ে আনে।
Print [1]