ডেইলী নিউজ বাংলা ডেস্ক , আপলোডের সময় : সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ , আজকের সময় : শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ : ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় 

কাজি মোস্তফা রুমি, স্টাফ রিপোর্টার :২৬ সেপ্টেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৫ আগস্টের মতো আরেকটি কলঙ্কিত দিন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট শুক্রবার ভোরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে এমন বর্বর, করুণ, হৃদয়বিদারক, নৃশংস ও কলঙ্কিত হত্যাকাণ্ডের দ্বিতীয় নজির নেই। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অন্যায়, অসাংবিধানিক এবং অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে মুজিব মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী বাংলার দ্বিতীয় মীরজাফর খন্দকার মোশতাক আহমেদ। বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪৪তম দিনে ২৬ সেপ্টেম্বর (১৯৭৫) অবৈধ রাষ্ট্রপতি মোশতাক এক বেআইনি ইনডেমনিটি (অব্যাহতি) অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে ১৫ আগস্টের খুনিদের দায়মুক্তি দান করে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে হয়তো আজও ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার হতো না।
অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। ইনডেমনিটি অর্থ অব্যাহতি বা দায়মুক্তি। ওই অব্যাহতি অধ্যাদেশে রাষ্ট্রপতি মোশতাক এবং তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সচিব এমএইচ রহমানের স্বাক্ষর ছিল। দায়মুক্তি অধ্যাদেশে দুটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশে বলা হয়, ‘১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভোরে আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।’ দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে. ‘রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন, তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো।’ অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। মুক্তিযোদ্ধা নামধারী জিয়াউর রহমান যে কত অন্যায়, অনাচার, জুলুম, নির্যাতন করে গেছেন, তা লিখে শেষ করা যাবে না। সর্বময় ক্ষমতার মালিক হয়ে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচনে জিয়ার দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসন দখল করে নেয়। ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল বুধবার ওই রাবারস্ট্যাম্প পার্লামেন্টের বৈঠক বসে। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী বানানো হয় চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে। পরদিন ৫ এপ্রিল কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স (দায়মুক্তি আইন) পাসের প্রাক্কালে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আজকে যদি এই আইন পাস করা হয় তাহলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে যে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যার কোনো রকম তদন্ত কিংবা কোনো মামলা বা বিচার করা যাবে না বলে যে অর্ডিন্যান্স জারি রয়েছে, সেটাই বহাল হয়ে যাবে।’ পার্লামেন্টে বিরোধী সদস্যরা আরো বলেন, ‘আজকে যদি এই আইন পাস হয়, তাহলে জেলের ভেতরে যে ৪ জন মহান নেতা, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই যুদ্ধকালীন সংকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানের হত্যার বিচার হবে না।’
পার্লামেন্টে এবং পার্লামেন্টের বাইরে জাতির পিতা ও চার নেতা হত্যার বিচারের যে দাবি উঠেছিল, তা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে ওইদিন (৫ এপ্রিল ১৯৭৯) সংবিধানের ৫ম সংশোধনী গৃহীত হলো। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের কতিপয় বিধানের অধিকতর সংশোধনকল্পে প্রণীত আইন ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯ সালের ১ নম্বর আইন পার্লামেন্টে পাস হলো।’ খুনিদের ‘দায়মুক্তি আইন’সহ ওই সংবিধানের কুখ্যাত পঞ্চম সংশোধনীতে বলা হয়, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ বা অন্যান্য আইন উক্ত মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোনো ফরমান দ্বারা এই সংবিধানের যে সকল সংশোধনী, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলোপ সাধন করা হয়েছে তাহা এবং অনুরূপ কোনো ফরমান, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ বা অন্য কোনো আইন হইতে আহরিত বা আহরিত বলিয়া বিবেচিত ক্ষমতাবলে অথবা অনুরূপ কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে গিয়া বা অনুুরূপ বিবেচনায় কোনো আদালত ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত কোনো আদেশ কিংবা প্রদত্ত কোনো দণ্ডাদেশ কার্যকর বা পালন করিবার জন্য উক্ত মেয়াদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশকৃত কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ অথবা প্রণীত, কৃত বা গৃহীত বলিয়া বিবেচিত আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং ওই সব আদেশ বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল এবং তৎসম্পর্কে কোনো আদালত ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো কারণেই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করার জন্য খুনি মোশতাক প্রণীত দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জিয়া তার রাবারস্ট্যাম্প পার্লামেন্টের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সংবিধানের মাধ্যমে আইনে পরিণত করল। এমনিভাবে হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ঘাতক জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে দেয়।
জনক হত্যার ৯ দিন পর ২৪ আগস্ট সেনাপ্রধান সফিউল্লাকে সরিয়ে উপপ্রধান জিয়াকে সেনাপ্রধান এবং মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে এরশাদকে উপপ্রধান নিযুক্ত করা হয়। মাত্র ৮০ দিনের মধ্যে ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর ভোর রাতে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের ৪ শীর্ষ নেতাকে জেলে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং ‘ডামি’ রাষ্ট্রপতি মোশতাককে সরিয়ে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে সেনাপ্রধান জিয়াকে ক্ষমতায় বসানো হয়। এরপর জিয়া রাষ্ট্রপতি সায়েমকে সরিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির গদিও ছিনতাই করেন। ওই সময় ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন বোস্টার।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২৩ জুন সরকার গঠন করে। ২৩ জুলাই সংসদ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবক্রমে গঠিত বিশেষ কমিটিতে প্রেরণের জন্য আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু দি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স-১৯৭৫-এর রহিতকল্পে আনীত বিল ১০ নভেম্বর ’৯৬ মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। ১০ নভেম্বর ১৯৯৬ জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি বাতিল বিল উত্থাপিত হয়। সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি জাতীয় সংসদের বিশেষ কমিটিতে প্রেরণ করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, বিএনপি এই কুখ্যাত অধ্যাদেশ বাছাই করার জন্য বিশেষ কমিটির সদস্য হয়েও কমিটির সভায় ইচ্ছাকৃতভাবে অনুপস্থিত ছিল। ১২ নভেম্বর ১৯৯৬ সুদীর্ঘ ২১ বছর ১ মাস ১৬ দিনের মাথায় জাতীয় সংসদে ভাবগম্ভীর ও বেদনাবিধুর পরিবেশে ইনডেমনিটি (বাতিল) আইন ’৯৬ সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। বিলটি উত্থাপিত হয় রাত ৮টা ৪৬ মিনিটে। পাস হয় ১০টা ৮ মিনিটে।
১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়ের করেন ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনের রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম। ওই দিনই মামলার অন্যতম আসামি মোশতাক সরকারের প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগেই বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১৩ আগস্ট ভোরে গ্রেপ্তার করা হয় কর্নেল ফারুক ও কর্নেল শাহরিয়ারকে। সিআইডি মামলার তদন্ত শুরু করে। সামরিক-বেসামরিক মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত ৬১ জন এ মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করেন। এর মধ্যে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সদস্য ৩৯ জন এবং বেসামরিক ব্যক্তি হলেন ২২ জন। প্রায় দেড় বছরে ১৪৯ কার্যদিবসে এই মামলার শুনানি হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর সকাল ১০টায় বিচারক মামলার রায় ঘোষণা করেন। ১৯ আসামির মধ্যে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৪ জনকে খালাস দেয়া হয়। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল রায় ঘোষণাকালে মৌখিকভাবে এবং লিখিতভাবে তৎকালীন সেনা কর্মকর্তাদের ভূমিকার সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদের কর্মকর্তারা বিশেষত, যারা তখন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। এমনকি তারা দায়িত্ব পালনের কোনো পদক্ষেপও নেননি। যদিও তাদের হাতে যথেষ্ট সময় ছিল।’
চূড়ান্ত বিচার শেষে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি কার্যকর করা হয়। ১ খুনি বিদেশে মারা গেছে আর বাকিরা চোর-ছেচ্চরের মতো বিদেশে পলাতক রয়েছে। এভাবে জনক হত্যার ৩৫ বছর পর ৫ আসামির সাজা কার্যকর হয়। পরে আরেক খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। মোশতাক-জিয়া-এরশাদ-খালেদারা শেষ পর্যন্ত বিচার বন্ধ রাখতে পারেনি।
 বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ৩ যুগ পরে হলেও জাতির পিতার ঘাতকদের বিচার করে জাতিকে দায়মুক্ত করেছেন। মোশতাক-জিয়ারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আজকে ১৫ আগস্ট হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যের খুনিদের চিহ্নিত এবং মোশতাক-জিয়াদের মরণোত্তর বিচারের দাবি উঠেছে। ইতিহাসে মরণোত্তর বিচারের নজির রয়েছে। এই লক্ষ্যে সরকার শিগগিরই একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মোশতাক-জিয়ারা কুখ্যাত ইনডেমনিটির মাধ্যমে খুনিদের বিচার বন্ধ রেখে প্রমাণ করেছে- তারা হত্যা-যড়যন্ত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।