ডেইলী নিউজ বাংলা ডেস্ক , আপলোডের সময় : বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২২ , আজকের সময় : বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

লালন মেলার আনন্দ

আমির হামজাঃ কার্তিকের এক তারিখ। ছেউড়িয়ায় লালন মেলা শুরু হয়ে গেছে। কুষ্টিয়া এক ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে যেন। লালনের দেশের মানুষ বলে হয়তো এক ধরনের টান অনুভব করি। সংস্কৃতি বেশ ভালোই চর্চা হয় এখানে।

তাই, কুষ্টিয়াকে সংস্কৃতির রাজধানী বলা হয়। এ শহরের অলি গলি, জনপদ ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি প্রাচীন বঙ্গদেশীয় ঐতিহ্য বহন করে। আমি অবশ্য গেছিলাম আমার ভাইয়ের কাছে লালন মেলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ওর অনার্স পরিক্ষা চলছিল। তাই, অনেকটা সময় পেয়েছি। কোনো কিছু না ভেবেই ফোনে তামিমকে জানালাম। কিছুক্ষণ পরই দেখি বন্ধু হাজির।

নেই কোনো প্লান, নেই কোনো গন্তব্য – দুই বন্ধু হেটেই চলেছি শহরের ওলি গলি। কিন্তু বসে যে একটা দুটো কথা বলবো সেটা হয়ে উঠছিলো না। সবশেষে, গড়াইয়ের পাড় আমাদের সে সুযোগ করে দিল। ঘোর দুপুর, অনেকখানি পথ হেটেছি, খালি পেট – কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ক্লান্তির রেশ মাত্র নেই। বন্ধুরাই বোধ করি জীবনের টনিক। বন্ধুরাই পারে বিষন্নতা দূর করে দিতে। যদি জীবন হয় একটি ছবি তবে বন্ধুরা হলো সে ছবির রঙ। যা-হোক, গড়াই পাড়ের স্নিগ্ধ হাওয়ায় বসে কোথায় যেন হারিয়ে গেছিলাম দু’জন। একটি ফোনকল এলো। দুপুরের খাবার সময় হয়েছে। যদিও বাইরে খাবার ইচ্ছে ছিল। শেষমেষ, বন্ধুর রান্না করা খাবার খেতে হলো। ঘন্টা খানেক বিশ্রাম নিয়ে বাইরে বেরোলাম। পাশেই মোহিনী মিল।

এতদিন বন্ধুর মুখেই মোহিনী মিলের কথা শুনতাম। আজ সামনে থেকেই দেখলাম। এই মোহিনী মিল ছিল তৎকালীন এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাপড় কল। ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য এখন অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে। কিন্তু মিলটি একসময় কুষ্টিয়া, পাবনা, নাটোর, পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় তাত কাপড় ও সুতার যোগান দিয়েছে। পরে, খানেক হেঁটেই দেখি টেগর লজ। টেগর লজের কথা খবরের কাগজে পড়েছিলাম কিন্তু যাওয়া হয়ে উঠত না। যা-হোক, আশপাশে কাউকে না দেখে আমরা লজের মধ্যে ঢুকতে কিছুটা কুন্ঠাবোধ করছিলাম।

হঠাৎই ভেতর থেকে ওই টেগর লজের পাহারাদার আমাদের ডাকলেন। লোকটা বেশ রাগী ধরনের। দেখি লজের ভেতর আরেকজন ভদ্রলোক টেবিল চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। আমাদের স্বাচ্ছন্দে চারদিক সাথে উপরতলা ঘুরে দেখতে বললেন উনি। ব্যাস, আমরাও ঘুরে ঘুরে রবি ঠাকুরের লজ অর্থাৎ বীবর ঘুরে দেখতে লাগলাম। আসলে রবীন্দ্রনাথ তার জমিদারি দেখতে এসে এখানে বিশ্রাম নিতেন। এখানে বসে কবি মূলত চিঠিপত্র রচনা করতেন। কবির রুচি ছিল বেশ। আমি তামিমকে বললাম,” দেখ, এরকম সুন্দর জায়গা হলে সুন্দর লেখা হবে এটাই স্বাভাবিক।”

পরে, উপরতলা থেকে নীচে নামতেই ভদ্রলোক আমাদের ডেকে বসতে বললেন। তিনি আমাদের অনুভূতি আর মন্তব্য জানতে চাইলেন। আর, একে একে বলতে লাগলেন টেগর লজ সম্বন্ধে। আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম আর ভাবছিলাম সেই সময়ের রবি ঠাকুরের কথা। আর বোধ হয় বঙ্গদেশে তাঁর মতো কেউ জন্মাবে না। মনে ভাবলাম, সাহিত্যের যুগ শেষ হয়ে গেল কী! হয়তো তাই হবে। ভদ্রলোক নিজের সম্বন্ধেও অনেক কথা বললেন আমাদের। তিনি এক সময় সাংবাদিকতা করেছেন। উনি পুরনো কিছু খবরের কাগজ দেখালেন। সেখানে তার বেশ অনেক গুলোই আর্টিকেল লেখা দেখলাম। উনি টেগর লজটির দেখভালের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। পরে, অবাক হলাম তখনই যখন তাঁর লেখা বইগুলো দেখাতে শুরু করলেন। উনি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটদের ছড়ার বই ইত্যাদি লেখেন। এ পর্যন্ত ত্রিশটার বেশি বই লিখেছেন ভদ্রলোক। প্রায়ই বইমেলাতে তাঁর বই প্রকাশিত হয়। এবছরও হবে। হ্যাঁ, উনিই – আখতারুজ্জামান চিরূ, একজন বিদ্রোহী প্রতিবাদী লেখক।

তিঁনি তাঁর “রোদ্রে ভেজা ত্রিকাল কথন” কবিতার বইটি থেকে আমাদের কবিতাংশ পড়ে শোনাচ্ছিলেন। দারুণ আবৃত্তি করেন তিঁনি। সন্ধে হয়ে গেছে। ভদ্রলোককে আমরা সম্মান জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিছুক্ষণের জন্যে সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো। বাইরে আবছা অন্ধকার। ওইদিকে আবার মেলা জমে উঠেছে। কাছেই ছেউড়িয়া। তাই, দুই বন্ধু লালন সাইঁজির আখড়ার উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। ধুলোবালি মাখা ওলিগলি, টিপটিপ স্ট্রিট লাইট জ্বলছে। তার মধ্যে হেঁটে চলেছে দু’জন বন্ধু; তাদের সাথ ঘেঁষে চলেছে দুটি ছায়া। হাঁটছি আর ভাবছি- তার মাইনে কম। লেখালিখি করে ভাত যোগানো বেশ কঠিন। তবে লেখক যে ভালো নেই তা বুঝেছি। আসলে এদেশে শিল্প-সাহিত্যের দাম কবেই বা ছিল। এমন অনেক আখতারুজ্জামান চিরূ সংগ্রাম করে চলেছে দিনের পর দিন। হয়তো লেখালিখি করে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। কিন্তু কারো নজর কাড়ছে না। হয়তো বা চিৎকার করে বলতে চাইছে কিছু। কিন্তু কেউ শুনতে পাচ্ছে না।