হোসনেয়ারা পারভীন,_সহকারি শিক্ষক মনিগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শুধু আমি নই, আমরা সবাই মনে অনেক স্বপ্ন নিয়ে বড় হই। এটা হবো, ওটা হবো। তবে আমি শিক্ষক বাবার সন্তান হিসেবে বরাবরই শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম।
আমার সে আশা পূর্ণ হয় ২০০১ সালে। দেখতে দেখতে ২২ টা বছর পেরিয়ে গেছে। ভালোই লাগে। তেমন কোন ক্লান্তি, শ্রান্তি, বিরক্তি নেই। নিষ্পাপ শিশুদের মাঝে বেশ আছি। ওদের সাথে গল্প করতে ভাল লাগে, গাইতে ভাল লাগে, নাচতে ভাল লাগে, খেলতে ভাল লাগে। যেদিন স্কুল বন্ধ থাকে সেদিন সময় যেন কাটতেই চাইনা। সংসারের সব কাজ আমাকেই করতে হয় তবে কাজ সেরে যখন স্কুলে আসি তখন শিশুদের কোলাহলে প্রাণ নেচে ওঠে। মনের আনন্দের খোরাক যোগানোর এখানে শিশুদের মাঝে অনেক কিছুই পাই। এতকিছুর মাঝে কিছু হতাশাও কাজ করে। যখন নিজের শতভাগ দিতে পারিনা তখন কারন খুঁযে বের করার চেষ্টা করি। কি থাকলে, কি করলে আরো ভাল কিছু হতো। কাংখিত সাফল্য আনার যারা চেষ্টা করবে তার মূল কারিগর যে আমরাই। আমদের জন্য শুধু প্রয়োজন একটা ভাল কারিকুলাম, ভাল দিক-নির্দেশনা, সচ্ছল জীবনযাত্রা আর সামাজিক মর্যাদা। শিক্ষকরা সমাজের খুব সম্মানিত ব্যাক্তি এটা একসময় সত্যি ছিল, কিন্তু এখন একটা বিরাট ধনিক শ্রেণী সৃষ্টি হওয়ার কারনে মর্যাদা পরিমাপের মানদন্ড পালটে গেছে। এখন আর শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতা পড়ে কেউ অনুপ্রাণিত হয়না। তবুও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বেশ কিছু সমস্যা প্রায়ই আমাদের মোকাবিলা করতে হয়। সমাধান দেয়ার অনেক মানুষ বসে আছে কিন্তু সমাধান শেষ পর্যন্ত নিজেদেরই করতে হয়। আমি এখানে বিদ্যালয় ব্যাবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের কথা বলছি। যে উদ্দেশ্যে বিদ্যালয় ব্যাবস্থাপনা কমিটি গঠন কতা হয় সে উদ্দেশ্য কতখানি পূরণ হয় সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এটা বিদ্যালয়ের মানোন্নয়নে কতটুকু কাজ করে জানিনা তবে ব্যাক্তি আধিপত্ত প্রকাশের চর্চাযে এখানে হয় সেটা বলা যায়। আমরা যেহেতু মাঠ পর্যায়ে কাজ করি, তাই সমস্যাগুলো আমরাই বেশি বুঝতে পারি। অনেক সমস্যার সমাধান হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরো হবে, আমরা আশা রাখি। এইযে, একসময় দেখতাম শিশুরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেনা, হাজার চেষ্টা করেও শতভাগ ভর্তি করানো যায়না। বিদ্যালয়ে শতভাগ উপস্থিতী ছিল অকল্পনীয়। সরকারের শতভাগ উপবৃত্তি প্রদানের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে সে চিত্র পালটে গেছে। এখন অভিভাবকরা শিশুদের খাবার নিয়ে মাঠে পাথানোর বদলে স্কুলে পাঠায়। যার কারনে শিশুদের উপস্থিতি ব্যাপক। যখন হোম ভিজিটে যায় তখন বুঝতে পারি অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে অনেক। তবে তাদের কাছ থেকে অনেক অভিযোগও শুনতে হয়। বিশেষ করে আমাদের বয়সী অভিভাবকরা তখনকার মজার মজার ছড়া, কবিতা, শিক্ষনীয় গল্প, প্রবন্ধের অভাবের কথা তুলে ধরেন। তাদের ভাষায় ঐ ছড়াগুলোতে এতই মজা ছিল যে তারা সেই কবে শিখলেও আজও ভোলেনি। আমিও যেমন সামনে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতি তবে পুরনো সবকিছুকে বাদ দিয়ে নয়। যে শিক্ষায় আনন্দ থাকেনা সে শিক্ষা শিশুরা গ্রহণও করতে পারেনা। নতুন আসুক, তবে তাতে যেন মজার ঘাটতি না থাকে। অভিভাবকদের কথা মনে ধরলো। নিজেই ছড়া লিখতে চেষ্টা করলাম একটা ছড়ার কথা উল্লেখ না করে পারছিনা। ছড়াটা এমন- বন্ধ দিঘী -হোসনেয়ারা পারভীন বন্ধ দিঘীর নিটোল জলে লাল পদ্ম ফোটে; সেই পাতায় নাচন করতে ডাহুক পাখি জোটে। ছেলে-মেয়ে কাটে সাঁতার ভর দুপুর বেলা। শাপলা ফুল তুলে এনে গাঁথে সবাই মালা। গাঁয়ের বধূ নাইতে নামে লজ্জা ভূষন ভাবে; জল কুমারী লাগে যদি জলে যখন ডুবে। হাঁসের দল খেলা করে দল বেঁধেযে তারা; তাদের সনে ভাসতে আমি থাকি পাগল পারা। শুকিয়ে গেলেও বন্ধ দিঘী চিহ্ন যে তার রহে; আবার যখন বর্ষা আসে তার বুকেতেই বহে। তারই বুকে ডিঙ্গি নৌকা চলে ছলাৎ ছলাৎ; চাঁদ যেন উছলে পড়ে যখন গভীর রাত। দখীন বাতাস যখন আসে জুড়ায় দেহ মন; বন্ধ দিঘী আমায় নিয়ে কাটায়যে তার ক্ষণ। শিশুরা অনেক মজা পেল। আমি নিজেকে জাহির করার জন্য নয় যে ছড়ায় মজা আছে সেটা শিশুদের মনে কতখানি ইমপ্যাক্ট ফেলে তা শেয়ার করার চেষ্টা করলাম। বর্তমানে শিশুদের মনস্তাত্মিক ব্যাপারটা উপলব্ধি করে খেলার ছলে আনন্দময় শিক্ষাদানের এক্সপেরিমেন্ট চলছে, এটা অত্যন্ত ইতিবাচক। একেবারে বছরের প্রথম দিনে বই পাওয়ার আনন্দ অত্যন্ত কাছে থেকে দেখি। এটা একটা বড় সফলতা। বিদ্যালয়গুলোতে এখন বিভিন্ন খেলার সামগ্রী দেয়া হচ্ছে। তবে রুটিনটা এমনভাবে করা হচ্ছে যে, শিশুরা খেলাধুলার খুব একটা সুযোগ পাচ্ছেনা। ভুলে গেলে চলবেনা যে অন্যান্য বিকাশের সাথে সাথে দৈহিক বিকাশটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিজস্ব মাঠ নেই। শুধুমাত্র হাইস্কুল সংলগ্ন বিদ্যালয়গুলোতে এই সুবিধাটা রয়েছে। যেখানে বেশিরভাগ শিশুই দরিদ্র পরিবার থেকে আসে সেখানে শিশুদের শতভাগ স্কুলড্রেস নিশ্চিতকরণ একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে সরকারে ১০০০ টাকা হারে কিডিং ভাতা দেয়ায় সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছে। একইরকম পোশাকে শিশুদের যেমন সুন্দর দেখায় তেমনি ধনী গরিবের ভেদাভেদও থাকেনা। এবার আসা যাক আমাদের কথায়। আমরাযে সবাই নিবেদিতপ্রাণ বা যোগ্য শিক্ষক তা বলবোনা। তবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ, যোগ্য শিক্ষক গড়ে তোলার যে কথা বলা হয় তা আসলে কতটা কাজে দেয় সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে ঠিকই কিন্তু এ শিক্ষা বিদ্যালয় পর্যন্ত কেন আসেনা এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছেও নেই। ভাল প্রশিক্ষকের অভাব, ভাল ব্যাবস্থাপনার অভাব, সর্বোপরী শিক্ষকদের আন্তরিকতার ঘাটতি এর কারন হতে পারে। শুধু শিক্ষকদের দায়ী করলেও চলবেনা। ‘শিক্ষকতা মহান পেশা’ বা ‘শিক্ষকরা সেবক’ এসব সান্ত্বনাদায়ক কথা আর কাজে দেয়না অতি দুর্বল বেতন কাঠামোর কারনে। এটা বুঝতে হবে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষক দিয়ে প্রথম শ্রেণির নাগরিক গড়ে তোলা অত্যন্ত কঠিন। শিক্ষকের মন থাকতে হবে প্রফুল্ল, তবেইনা ভাল কিছু হবে। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নিদারুন। যে শিক্ষক নিশ্চিন্ত মনে ক্লাশে যাবে তার মনে সংসার চালোনোর দুশ্চিন্তা ঢুকে থাকে। ফলশ্রুতিতে কাংখিত সাফল্য অর্জনের অগ্রসৈনিকরা হীনমন্যতায় ভোগে। মানুষ এখন প্রভাবশালীকে ফলো করে, স্বল্প বেতনভোগী শিক্ষকদের গুরুত্ব খুব কমই দেয়, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের। অভিভাবকরা প্রভাবশালীদের গড়া কিন্ডার গার্টেনের দিকে ঝুঁকছে এবং এটাতে তারা গর্ব তথা তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। এটাও বলা হয় প্রাইমারি স্কুলের ২০০ টাকা টিফিনভাতাভোগী গরিব শিক্ষকদের স্কুলে কেবল গরিব শিশুরাই যায়, অথচ তারা ভুলে যায় এখান থেকে অনেক কৃতিসন্তানের পথচলা শুরু। বড় কষ্ট লাগে! এদিকে দৃষ্টি দেয়া জরুরী। আমরা এমন আহামরি কিছু চাইনা, শুধু এটুকুন দিলেই চলবে যেটুকুনে সমাজে অন্তত: আমাদের ছোট করে দেখা হবেনা। কারিকুলামটা হওয়া উচিৎ এদেশের স্ট্যান্ডার্ড এর। এখনো সময় আসেনি বিদেশী শিক্ষা ব্যাবস্থার সাথে তাল মেলানোর। যেটা বুঝতে শিক্ষকেরই অনেক সময় লেগে যায় তেমন কিছু না আনাই আমি শ্রেয়তর বলে মনে করি। বিদ্যালয়ের সমসূচির বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে একটা কথা শেয়ার করতে পারিযে ছোট ছোট শিশুদের এতটা সময় স্কুলের গন্ডিতে না রেখে সময় কমালে তাদের মনোযোগের ঘাটতি হবেনা। অধিক সময় ধরে ক্লাশে অবস্থানে শিশুরা বিরক্তি অনুভব করে এবং শিখনে মনোযোগের ঘাটতি তৈরি হয়। বিষয়টা নিয়ে ভাবার আছে। সরকার প্রতিবছর বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন খাতে যে বরাদ্দ দেয় তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য সকল শিক্ষককে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এতে শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতার ঘাটতি দূর হবে তথা আন্ত:সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে এবং উন্নয়ন নিশ্চিত হবে বলে মনে করি। আরো অনেক কথা বলার আছে। ইনশাআল্লাহ পরবর্তী লিখায় তা প্রকাশ করবো। প্রাথমিক শিক্ষা এগিয়ে যাক। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের মা, আগামী দিনের বাবা। এই মায়েদের কল্যানেই নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কথার রেশ ধরে আমরা একটি শিক্ষিত জাতি উপহার পাবো আশা করি।