শৈশব ও বব কাট
সেলিনা আখতার ঢাকাঃ ~ আম্মা, ও আম্মা , তুমি কিন্তু এবার ঈদে দাদা বাড়ি যাওয়ার আগে আমার চুল ববকাটিং করে দিবা। আম্মা যেন সপ্তম আসমান থেকে পড়লো! ববকাটিং, সেইটা আবার কি? ববকাটিং চিননা? ঐ যে সেইদিন খালা, খালু সবাই মিলে হলে সিনেমা দেখতে গেলাম না? দূরদেশ নাম সিনেমার। ওই সিনেমায় ববিতার যে চুলের স্টাইল ছিল, আমার ক্লাসের ডালিয়া,সুচনা,খুকুমনি ওরা বলছে, ববিতার চুলের ওই স্টাইলের নাম নাকি ববকাটিং। ডালিয়ারে চিননা? ওই যে ফার্মের পাশেই বাড়ি, ওর একটা ফুপু আছে না? বেলি ফুপু, উনি বলছে ববকাটিং করলে আমারে নাকি দেখতে অনেক সুন্দর লাগবে। ঐ যে সেদিন, আব্বার সাথে মোটর সাইকেলে করে মোয়াজ্জেম আংকেল এর বাসায় গেলাম, দেখলাম উনার মেয়ে বিউটি আপাও চুল ববকাটিং করছে। আম্মা দিওনা আমার চুল ওমন করে কেটে। আম্মা বলে, যা দেখা যাবে আগে ঈদ আসুক।
রাতদিন কতরকম চিন্তা মাথায় দৌড়াদৌড়ি করে, নতুন চুলের স্টাইলে আমাকে দেখতে কেমন লাগবে! আব্বা ফিলিপাইন থেকে যেই মেকাপবক্স টা নিয়ে আসছে, ওইটা দিয়ে ঈদের দিনে সাজবো। আনটিরা দেখি কিসব চোখে মুখে লাগায়, আইশ্যাডো, ফেস পাউডার। আম্মা এইসব কিছু দিয়ে সাজতে দেয়না,বলে এগুলি বড়োদের জিনিস! ছোটরা এইসব দিয়ে সাজলে স্কিন নষ্ট হয়ে যায়। ভাবতাম, তাহলে আব্বা কেন এগুলি কিনে দিছে! পরে জেনেছি, ওই মেকাপবক্স আসলে আব্বা আমার জন্য নয়, আম্মার জন্য এনেছিল। যেহেতু আমার আম্মা কখনো সাজগোজের ধারপাশেও ছিলনা, তাই ওইটা ভাগ্যক্রমে আমার হয়েছিল। প্রত্যেক ঈদে আব্বা আমাদের দুইবোনকে ইম্পেরিয়াল লেদার সাবান কিনে দিত। সাবানের ওই লাল-সোনালি প্যাকেটটা আমার খুব প্রিয় ছিল। আমি সাবানের প্যাকেট টা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ উল্টিয়ে পালটীয়ে দেখতাম। সাবানের সুন্দর গন্ধ শুঁকতে খুব ভাল লাগত আমার।
বাড়ি গেলে আমার সব চাচাতো, ফুপাত বোন- আঞ্জুআপা, জুলেখা, মিনু, লাকি, সমবয়সী চাচাতো-ফুপু শিখা, শিলা, রেবেকা সবাই হচ্ছে আমার খেলার সাথি। একসাথে নদীতে গোসল করতে যাই,আর প্রত্যেক বার সবান হারিয়ে আসি । নদীতে গিয়ে হই-হুল্লোর করা, নদীতে পানি কম থাকলে নদীর কিনার ঘেঁষে গামছা দিয়ে মাছ ধরা, আহা! সেদিন কি ভুলা যায়! যখন নদীর পানি যখন কমতে থাকে, যাদের নৌকা আছে, অনেকেই নৌকা পানিতে ডুবিয়ে রাখে। সেই ডুবানো নৌকায় চিংড়ি, টাকি, শোল, ট্যাংড়া, পুঁটী রাজ্যের মাছ এসে জমা হয়। আমরা গামছা দিয়ে সেই সব মাছ ধরি। কত যে মজা হয়! বাড়ি গেলে আমার আর শহরের বাসায় ফিরে আসতে ইচ্ছা হয় না। এবার বাড়ি গেলে আমার সব সাজের জিনিসপত্র দিয়ে আমার খেলার সাথিদের কে সাজিয়ে দিব। ওরা আমার বাড়ি যাওয়ার অপেক্ষায় থাকে। কি প্রচণ্ড মায়া আমার প্রতি সবার ! আমার এইসব সাজের জিনি্সপত্র দিয়ে সাজিয়ে দিলে নিশ্চয় ওরা অনেক খুশি হবে।
দেখতে দেখতে ঈদ তো চলে আসলো, কিন্তু আমার চুলের ববকাটিং তো আর হয়না। আর মাত্র কয়দিন বাকি আছে বাড়ি যাওয়ার। সেল্যুনের নির্মল কাকা, যে আমাদের বাসায় এসে চুল কাটে, উনাকে দেখলাম আমাদের গোল বারান্দাতে আব্বার চুল কাটে। আম্মার পিছন পিছন অনেক্ষন ঘ্যান ঘ্যান করলাম, কোনও লাভ হলনা। এদিকে আমার মন তো ভীষণ অস্থির আর অশান্ত, আমার সব স্বপ্ন, আর সাধ বুঝি বৃথা যায়! কত ইচ্ছা ছিল! আমার চুলের এই নতুন স্টাইল দেখে আমার সঙ্গী সাথিরা কত অবাক হবে। এইটা ,ওইটা কতকি জিজ্ঞেস করবে। আর আমি ভাব নিয়ে বিজ্ঞের মত সব গল্প করবো।
স্কুল থেকে বাসায় ফিরছি, নির্মল কাকার স্যালুন টার সামনে এসে আমার পা দুটো যেন অসার হয়ে গেল! কোথা থেকে এক দুষ্ট বুদ্ধি মাথায় ভর করল! যখনি চিন্তা, তখনি কাজ! স্টিলের তৈরী বই এর বাক্সটাকে স্যালুন ঘরের এক পাশে রেখে নির্মল কাকাকে বললাম, কাকা আমার চুল ববকাটিং করে দিতে হবে। উনি বলল স্যার, আপা, মানে আমার আব্বা , আম্মা যদি রাগ না করে তবে কেটে দিতে পারে। আমি অভয় দেওয়াতে রাজি হল। উনি চুলের এই নতুন স্টাইল এর কি বুঝল কে জানে! শুরু হল আমার ইচ্ছা পুরন এর কাজ।অবশ্য আমিও মাঝে মাঝে একটু আধটু মাতব্বরি করতে ছাড়ি নাই। সেই সব দিন গুলিতে তো আর এখন কার মত স্যেলুন এর চাকচিক্য ছিলনা। কাজ শেষে নির্মল কাকা একটা আয়না সামনে ধরে বলল দেখতো আম্মু, কেমন হয়ছে? দেখলাম সব ঠিকঠাকই আছে, শুধু সামনের দিকে ছেলেদের মত চিপ রাখছে! মাথার পেছন দিকটা তো আর আমি দেখতেই পাইনি।
স্কুল থেকে ফিরতে দেরি দেখে ততক্ষণে আমাকে খোঁজাখুজি শুরু হয়ে গেছে। যদিও আমার স্কুল,হরিশংকরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কুষ্টিয়া ফিশারি ফার্ম এর দূরত্ব খুব বেশি নয়, এবং এই এলাকায় ফার্ম ম্যানেজার হিসাবে আমার আব্বা বেশ সুপরিচিতও বটে। স্যালুন থেকে বের হতেই আব্বার অফিসের পিওন সাত্তার কাকা বলে,আম্মু তুমি কোথায় গেছিলা? আমরা তো তোমারে খুজতে খুজতে হয়রান! আর একটু এগুতেই দেখি আমার ছোট কাকা! কাকার অবাক জিজ্ঞাসা,কোথায় গেছিলি? বাহ! চুলের কি ডিজাইন, কি সুন্দর দশা করছে চুলের! শুনে আমি তো মহাখুশি! নিজের বাহবা নেওয়ার জন্য বলি, নির্মল কাকা তো কিছুই বুঝেনা। আমি বলে বলে বুঝায়ে দিছি কেমনে কাটতে হবে। কাকা বলে আর মুচকি হাসে,হুম খুব সুন্দর হয়ছে! বাসায় চল, দেখ ভাবি কত খুশি হয়! আমি এতোটা বোকা ছিলাম যে কাকার হাসির সেই গুরু রহস্য কিছুই বুঝতে পারিনি ।
যেমনেই বাসার দরজায় পা রাখছি , অমনেই আম্মার হুংকার! কত বড় সাহস মেয়েের!এত সুন্দর চুলগুলির এই দশা করছ? মেয়ে আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন! দেখছ চুলের সামনের কি দশা! আর পিছনে করছে বাটিছাট? আয় আমার সাথে, তোরে আজকে ববকাটিং শিখাই! এই বলে আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো কলতলায়। তারপর দুই ডানা ধরে উঁচু করে একটা শক্ত কাঠের টুলের উপর ঠাস করে বসিয়ে বলল, এখান থেকে এক পা সরছিস, তো মরছিস! তারপর কোথা থেকে একটা নতুন ব্লেড নিয়ে এসে আমার চুল গুলি চাঁছতে সুরু করলো। আহারে! আমার এতো সাধের চুল… চোখের পানি, নাকের পানি আর কলের পানি সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। এমনেতেই খুব অসহায় মনে হচ্ছে। তারপর আবার বাসার কাজের মেয়ে শামেলা, আমার জন্য কল থেকে গোসলের পানি বালতিতে ভরে, আর বত্রিশ দাঁত বের করে হাহা করে হাসে। দেখে রাগে আমার পিত্তি জ্বলা অবস্থা ! মনে মনে ভাবি, দাঁড়া একবার তোরে বাগে পাই…
আম্মা আমাকে গোসল করিয়ে আয়নার সামনে দাড় করিয়ে বলে, দ্যাখ টাক মাথায় এবার কেমন লাগে ? সেই আয়না দেখার সাথে সাথেই জলাঞ্জলি হলো আমার এতো দিনের পরিকল্পনার! আহারে! আমার সাধের হেয়ার স্টাইল! যদিও আম্মা পরে আমার সেই অতি পছন্দের স্টাইলে অনেকবার চূল কেটে দিয়েছে। কিন্তু ক্লাস ফোরে পড়াকালীন সময়ের এই ঘটনা টা আমার চোখে বার বার ভেসে উঠে। আজ এত বছর পরেও এই ঘটনাটা মনে করে নিজে নিজেই হাসি। হায়রে শৈশব! যদি আর একবার ফিরে পেতাম…
Print [1]