শিক্ষক উম্মে হাবিবার চিন্তায় নতুন কারিকুলাম
নতুন কারিকুলাম নিয়ে চারিদিকে বহু কথা, বহু সমালোচনা, বহু রটনা। নতুন কারিকুলামে আসলে কী শেখানো হচ্ছে শিক্ষার্থীকে? আমি একজন শিক্ষক। আমার কাছে নতুন কারিকুলাম কেমন সেটা কি জানতে চাওয়া হয়েছে কখনো!
হয়নি!! ক্লাসে পড়াচ্ছি আমরা,শিখছে শিক্ষার্থীরা। ২০২২ সালে বাংলাদেশের ৬২ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইলটিং করার পর ২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠদান কার্যক্রম শুরু করেছে। বর্তমানে ২০২৪ সালে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতেও নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠদান প্রক্রিয়া চলছে।
আমরা পুরনো মুখস্থ নির্ভর পদ্ধতির সাথে এতোটাই মিশে গিয়েছি যে পরীক্ষা আর পরীক্ষা এবং A+ এর পেছনেই ছুটে চলছি! ছেলেমেয়ে বিজ্ঞান বিভাগেই পড়তে হবে। সে ফেল করুক আর পাস করুক। কোনোমতে টেনেটুনে পাস করে প্রাইভেট মেডিকেলে ডাক্তারি পড়ে ডাক্তার! কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ইঞ্জিনিয়ার!
পরীক্ষায় যে শিক্ষার্থী ৩৩ পায় সে কিন্তু ফেল! ফেল মানে ফেল। ওর কোনো যোগ্যতাই নাই। লজ্জায়, অপমানে গলায় দড়ি আর না হয় ঘুমের ওষুধ খেয়ে মৃত্যু!
কিন্তু কেউ কি একবারও ভেবে দেখেছে যে শিক্ষার্থী ৩৩ পেয়েছে সে অবশ্যই যোগ্য। ৩৩ পেয়েছে মানে ওর কিছু যোগ্যতা অবশ্যই আছে। সেটার মূল্যায়ন কোথায়! আমাদের এই নম্বর পদ্ধতি কতো শিক্ষার্থীদের জীবন নষ্ট করে! আমাদের চাপিয়ে দেওয়া পড়ার ওজন ও বইতে পারে কি! কখনো ওর বয়:সন্ধিকালের পরিবর্তন নিয়ে ভেবেছেন কি! ওর কী করতে ইচ্ছে করে, ওর পরিবর্তিত মন ও শরীর কী কী সমস্যায় ভুগছে! ও কী চায়! ভেবেছি আমরা! ওরা খারাপ কী করলো,কতটুকু পড়লো, কেন ফেল করল?- এসব নিয়েই আমাদের চিন্তা। ফলাফল হয় আমাদের ছেলেমেয়েরা মানসিক রোগী আর না হয় ভয়াবহ মেধাবী মানে তথাকথিত গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ!
ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যতে কী হতে চায় সেটার উত্তর অভিভাবক ঠিক করে! হয়তো ছেলেটি শেফ হতে চায় বা মেয়েটি ফুটবলার হতে চায়! ওরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় না!! জোর করে ফেল করে করে ডাক্তার হয় যে শিক্ষার্থী সে আসলে কি শিখেই ডাক্তার নাকি টাকা খরচ করে ডাক্তার!! ভুল চিকিৎসার পিছনে এটাও কি কারণ হতে পারে না!
আমি বলছি না চোখের পলকে নতুন কারিকুলাম সব বদলে দেবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের যে ১০টি যোগ্যতা অর্জন করতে হবে হাতে কলমে বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সেটা কি যৌক্তিক নয়! একজন শিক্ষার্থী জীবনের বেসিক শিক্ষাগুলো অর্জন করে জীবনে যা হতে চায় হোক। ওদের জন্য সব উন্মুক্ত। সাহিত্য চর্চা, নাচ,গান, আর্ট,রান্না,কৃষিকাজ, সঞ্চয় করার শিক্ষা ইত্যাদি সব। ও সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আনন্দের মাধ্যমে পড়ে শিখে জেনে সিদ্ধান্ত নেবে যে ও জীবনে কী হতে চায়।
রান্না নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হলো! একটা ছেলে বা মেয়ে ভাত, ডাল,আলুভর্তা, ডিমভাজা কেন শিখবে না! ওর জীবনে বেসিক রান্না জানা কি জরুরি না! বাসায় মা অসুস্থ হলে কিংবা হোষ্টেলে থাকলে কিংবা দেশের বাইরে গেলে ও রান্না জানলে কি ভালো হবে না! রান্না কি শুধু বাবুর্চির কাজ? একজন ছেলে বা মেয়ে বাসার সকল কাজে মা- বাবাকে সাহায্য করবে এটাইতো স্বাভাবিক আচরণ হওয়া উচিত।
আমাদের ছোটোবেলায় আমাদের অনেককিছু করতে ইচ্ছে করতো। গল্প, কবিতা, নাটক বা ভ্রমণ কাহিনি আমরাও লিখতে পারতাম। কিন্তু কখনো আমাদের সুযোগ দেওয়া হয়নি! কথা বলাও যে একটা দক্ষতা এটা আমরা কয়জন জানতাম?
নতুন কারিকুলামে আমাদের শিক্ষার্থীরা নিজেরাই কাজ করে, প্রেজেন্টেশন দেয়! গল্প লিখছে, কবিতা লিখছে, ভ্রমণ কাহিনি লিখছে,নাটক লিখছে,গান লিখছে!! মজার ব্যাপার শিক্ষার্থীরা কিছু শিখছে না বলে আমরা চিৎকার করছি, মিটিং করছি, সমাবেশ করছি। অথচ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার বেড়ে গিয়েছে!! অনুপস্থিত থাকে খুবই কম শিক্ষার্থী। ওরা কিন্তু আনন্দের সাথেই সব কাজ করছে। মোটেও ওদের সারাদিন মোবাইলে কোনো কাজ দেওয়া হয় না। পাঠ্যবইয়ে এমন কোনো কাজ নেই যে সারাদিন ওদের মোবাইল ফোন নিয়ে থাকতে হবে। খুব প্রয়োজনে অবশ্যই শিক্ষার্থী ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করবে।
আপনি, আমি আমরা সবাই আমাদের প্রয়োজনীয় তথ্য ইন্টারনেট থেকেই সংগ্রহ করি। তাহলে আমার বিংশ শতাব্দীর সন্তান কেন ইন্টারনেট ব্যবহার করবে না! কিন্তু সারাক্ষণ ফোন নিয়ে থাকার মতো কোনো কাজ নতুন কারিকুলামে নেই। যদি কোনো ছেলেমেয়ে সেটি করে তাহলে অবশ্যই আপনাকে আমাকে অভিভাবক হিসাবে মনিটরিং করতে হবে।
আমি বলছি না কোনো সমস্যা নাই। সমস্যা আছে অনেক-বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সংকট, অবকাঠামোগত সমস্যা, সনাতন চিন্তাচেতনা, অতিরিক্ত শিক্ষার্থী, দৃষ্টিভংগির সমস্যা ইত্যাদি।
কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বে আধুনিক বিশ্বের শিক্ষার সাথে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের তাল মিলিয়ে চলার দক্ষতা অর্জন করানো। একটা নতুন জিনিস প্রতিষ্ঠিত হতে কিছু সময় প্রয়োজন। আমরা সকলে মিলে নিশ্চয়ই নতুনকে গ্রহণ করে আমাদের সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারবো।
হোক না আমার সন্তান গায়ক, লেখক, কৃষক, চিত্রশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, ইসলামিক ব্যাক্তিত্ব, উদ্যোক্তা! ওর পছন্দ অনুযায়ী ও ওর ক্যারিয়ার বেছে নিবে। একজন আদর্শ মানুষ তৈরি হতে আমরা সাহায্য করি।
সুন্দর ফিডব্যাক দিয়ে কীভাবে কাজকে সুন্দর করা যায় সেটা চিন্তা করি। কোচিং বাণিজ্য কমে যাক। শিক্ষার্থীর চিন্তিত দক্ষতার বিকাশ হোক। একজন আদর্শ মানুষ হোক আমাদের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা।
আমাদের সন্তানেরা ধর্মচর্চা করছে। হাতে- কলমে শিখছে ধর্মীয় আচার আচরণ যা আগে বিদ্যালয়ে এভাবে শেখানো হতো না। ওযু করা, নামাজ পড়া,প্রার্থনা করা সকল বিষয় এখন প্রাকটিস করানো হচ্ছে বিদ্যালয়ে।
পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে শিখি আমরা। একেবারে না পারলে গ্রহণ করার চর্চা করি। আপনি আমি পিছিয়ে থাকলে আমাদের সন্তানও পিছিয়ে থাকবে। আমরা কি চাই আমাদের সন্তানেরা পিছিয়ে থাকুক? চাই না।
তাহলে আসুন সন্তানের বন্ধু হই। সে কী শিখছে ওর কাছে শুনি। ওকে সাহায্য করি। নৈতিক শিক্ষার চর্চা করাই।
লেখক:
উম্মে হাবিবা
সিনিয়র শিক্ষক
গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল,
ঢাকা।