চন্দনা বারাশিয়া নদীর পানি অটোরাইচ মিলের বর্জে দূষিত, মাছ বিলপ্তি, আইনের তোয়াক্কা করছে না মিল মালিক
লাখ জনতার জন্য চন্দনা বারাশিয়া মরে যাওয়া নদী পুন: খনন করেন মন্ত্রী, নদীর ভেতরে অটোরাইচ মিলের বর্জ ফলে নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী করছেন অটোরাইচ মিল মালিক।
বোয়ালমারী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি: দখল আর দূষণে নাভিশ্বাস উঠছে এক সময়ের উত্তোল চন্দনা বারাশিয়া নদী। এই চন্দনা বারাশিয়া নদী দিয়ে এক সময় চলতো লঞ্চ, স্টিমার আর বড় বড় পালতোলা নৌকা সেই নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বারাশিয়া নদীর জন্য বোয়ালমারীতে গড়ে ওঠে ব্যবসায়িক কেন্দ্র। এমনকি এই নদীতে প্রচুর বোয়াল মাছ পাওয়া যেত। বোয়াল মাছের জন্য এখানকার নামকরন করা হয় বোয়ালমারী। ২০১৯ সালের এক রায়ে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তার’ আইনি মর্যাদা দিয়েছে হাইকোর্ট। কিন্তু বাস্তবে দখল আর দূষণে নদী টিকে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
স্থানীয় একটি রাইচ মিলের বর্জ্য, মানববর্জ্য, পৌর শহরের বাসাবাড়ির বাসিন্দাদের ময়লা-আবর্জনা নদীর পানি বিষাক্ত করে তুলেছে। এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন বারাশিয়া নদীর দুই পাড়ের হাজর হাজার মানুষ। নদীর পানি পঁচে যাওয়ায় মানুষের কোন কাজে আসছে না নদীর পানি। চরম বিপাকে আর ভোগান্তিতে আছে নদীর দু পাড়ের মানুষ। এ ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহনের অনুরোধ করেন স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি। একটি ইটভাটা মাটি ও কাঁচা নষ্ট ইট ফেলে প্রায় ভরাট করে ফেলেছে নদী। এ ছাড়া নদীর দুই পাশের অংশ দখল করে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক ও বানিজ্যিবসহ নানা স্থাপনা।
বিকাশ এগ্রো ফুডের রাইচমিলের বর্জ্যতে দূষিত হচ্ছে বারাশিয়া নদীর পানি। চন্দনা-বারাশিয়া নদীর পানি পঁচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মরে গেছে নদীর মাছ। নদী পাড়ের মানুষেরা কোন কাজেই ব্যবহার করতে পারছে না নদীর পানি। মৎস্যজীবিরা পারছেনা মাছ ধরতে। পঁচা পানির কারণে নদীতে নামতে পারছেনা জেলেরা। এ জন্য বিপাকে পড়েছে নদী পাড়ের মানুষ। নদী পাড়ের মানুষের অভিযোগ, উপজেলার সোতাশীতে অবস্থিত বিকাশ এগ্রোফুডের অটোরাইচ মিলের বর্জ্যরে কারণেই দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করে জনবসতি এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে এ মিলটি। লোকালয়ের এক কিলোমিটার বা এক হাজার ৯৮ গজের মধ্যে এ ধরনের মিল স্থাপন না করার নির্দেশ আছে। তবে সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিকাশ এগ্রোর মালিক পক্ষ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নদী পাড়ে অবস্থিত ময়না ইউনিয়নের ঠাকুরপুর বাজারের উজানে সোতাশী পয়েন্টে একটি বড় পাইপ দিয়ে নদীতে পড়ছে ময়লা পানি। এটি বিকাশ এগ্রোর অটোরাইচ মিলের পাইপ বলে জানা গেছে। দৃশ্যমান এ পাইপের নিচের দিকে আরও ২টি পাইপ আছে বলে জানা গেছে।
নদী পড়ের বাসিন্দা সোতাশী গ্রামের ওয়াদুদ মোল্যা বলেন, সারা বছরই পানি কালো ও গন্ধ হয়ে থাকে। বর্ষার সময় পানি একটিু বেশি হলে শুধু পানির রং ঠিক থাকে। আগে এ নদীর পানি দিয়ে আমরা গোসল করতাম, রান্নার কাজে ব্যবহার করতাম, গরু-বাছুর গোশল করাতাম। এখন কোন কাজেই আসে না নদীর পানি। আলেয়া বেগম বলেন কাপড়-চোপড় ধোয়া যায় না। পঁচা গন্ধে বাড়িতে টেকা যায় না।
ঠাকুরপুর বাজারের মাছ ব্যবসায়ী বাচ্চু খান অভিযোগ করে বলেন, অটোরাইচ মিলের পঁচা পানি পড়ে নদীর পানি নষ্ট হয়ে নদীর মাছ মরে গেছে। নদীতে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। পঁচা পানির কারণে নদীতে মাছ ধরতে নামতেও পারছে না মৎস্যজীবিরা। এর আগে আমরা আন্দোলন সংগ্রাম করেছিলাম কিন্তু কোন কাজ হয় না। দিনের পর দিন এ কাজ করে যাচ্ছে বিকাশ এগ্রো।
ঠাকুরপুর বাজার বণিক সমিতি সভাপতি মো. মতিয়ার বিশ্বাস বলেন, রাইচ মিলের বর্জ্যরে কারণে নদীর পানি পঁচে গেছে। পঁচা পানির গন্ধে বাজারে টিকা যায় না। মসজিদে নামাজ-কালাম পড়তেও সমস্যা হয়। নদী পাড়ের হাজার হাজার মানুষ নদীতে গোসল করতো, তারা গোসল করতে পারছে না। মিলের সন্নিকটে সোতাশী গ্রামের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
ময়না ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক নাসির মো. সেলিম বলেন, নদী পাড়ের হাজার হাজার মানুষ নদীতে গোসল করতো, বিভিন্ন কাজে পানি ব্যবহার করতো, গরু বাছুর গোসল করাতো কিন্তু বিকাশ এগ্রো ফুডের বর্জ্যরে কারণে পানি নষ্ট হয়ে গেছে। বোয়ালমারী বাজারের বসতবাড়ির বর্জ্য ড্রেন ডিয়ে মিসছে নদীর পানিতে। বাজারের এবং বিভিন্ন বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নদীতে। ঠাকুরপুর ব্রিজের উত্তর পাশে সাবেক পৌর মেয়র আব্দুস শুকুর শেখের মেসার্স রাজ ট্রেডার্সের ইটভাটা নদীর প্রায় পুরাটাই দখল করে নিয়েছে। মাটি আর নষ্ট কাঁচা ইট ফেলে ভরাট করে ফেলেছে নদী। পৌর সভার সদর বাজার এলাকায় নদীর মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে অনেক স্থাপনা। তালতলা বাজারসহ বিভিন্ন হাটবাজার এলাকায় নদী দখল করে গড়ে উঠেছে দোকানপাটসহ বিভিন্ন প্রকার স্থাপনা।
বোয়ারমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য মো. আকরাম মিয়া অভিযোগ করে বলেন, বিকাশ এগ্রোর যতো ক্যামিকেল আর বোয়ালমারী বাজারের সকল বর্জ্য মিলে চন্দনা বারাশিয়া নদীর পানি পঁচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আর দখল করতে করতে তো নদী শেষ। দখলদাররা এমন ভাবে দখল করেছে যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একটা স্মৃতিসৌধ আছে তা পুরোপুরি ঢেকে ফেলেছে।
নদী এলাকায় সেচ সুবিধার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎস্যমুখে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি, সুপেয় পানির আধার তৈরিসহ এলাকার আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়নকল্পে তৎতালিন এমপি (বর্তমান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী) মো. আব্দুর রহমানের প্রচেষ্টায় ২০১০-১১ অর্থ বছরে চন্দনা-বারাশিয় নদী খনন করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। কিন্তু দখল দূষণে এখন নদীর অবস্থা কাহিল। বিশেষ করে বর্জ্যরে কারণে পানি পঁচে যাওয়ায় কোন কাজে আসছে না চন্দনা-বারাশিয়ার পানি।
বিকাশ এগ্রো ফুডের মালিক বিকাশ সাহা এ সকল অভিযোগ মানতে নারাজ। তিনি বলেন, রাইচ মিলে কোন ময়লা, পঁচা পানি হয় না। এমনকি রাইচ মিলে কোন বর্জ্য নেই। তিনি নিজে পাইপ দিয়ে পড়া পানি খেয়ে দেখেছে বলে জানান। তিনি দাবি করেন, এ পানি খেলেও কিছু হয় না। বোয়ালমারী বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে পানি দূষিত হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। যদিও ময়লা আবর্জনা ফেলার সে স্থানগুলো আরও ভাটিতে। তিনি আরও বলেন, কুষ্টিয়াসহ সারা দেশে হাজার হাজার মিল চলছে। সেসব মিল নদীতে পানি ফেলছে। সেখানে কিছু হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেয়ে এবং সকল বিধিমোতাবেক মিল করেছেন বলে তিনি দাবি করেন। যদিও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র দেখাতে পারেননি। তবে ছাড়পত্রের জন্য টাকা জমা দিয়েছেন এবং টাকা জমাদানের চালান দেখান তিনি।
মেসার্স রাজ ট্রেডার্সের পরিচালক শেখ জসিম বলেন, ভাটায় কাজ করার সময় কিছু মাটি, নষ্ট কাঁচা ইট পড়েছে। পরে আমরা ওই মাটি বেকু দিয়ে তুলে ফেলবো। নদী আর ভরাট থাকবে না।
ময়না ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হক মৃধা বলেন, মিলের বর্জ্যে আমার ময়না ইউনিয়নের মধ্যে বারাশিয়ার পানি নষ্ট হয়ে গেছে। পানি পঁচে যাওয়ার কারণে দেশীয় মাছ মরে গেছে। মৎস্য সম্পদ পুরাই ধ্বংস হয়ে গেছে। পরিবেশ পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় লোকজন মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এ অন্যায় অত্যাচার বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে ফরিদপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাইদ আনোয়ারের বক্তব্য চেয়ে ম্যাসেজ দেওয়া হলেও কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. মেহেদী হাসান বলেন, নদী আমাদের সম্পদ। সেই নদীকে মেরে ফেলা যাবে না। এসব বিষয়ে প্রয়োজণীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (ওয়াপদা) উপসহকারী প্রকেীশলী সন্তোশ কুমার বলেন, যারা অবৈধ দখলদার আছে আমরা তাদের একটা তালিকা করেছি। অচিরেই প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালাবো। সাথে দূষনের বিষয়টাও দেখা হবে।
Print [1]