বগুড়ায় স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে গলাকেটে হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের
রাবেয়া সুলতানা,, (বগুড়া) প্রতিনিধি : বগুড়ার শাজাহানপুরে আবাসিক হোটেলে আশামনি (২১) ও তাঁর ১১ মাস বয়সী শিশু আব্দুল্লাহকে হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে৷ গত রোববার দিবাগত রাতে নিহত আশামনির বাবা আসাদুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় হত্যার কারণ অজানা দেখিয়ে নিহত আশামনির স্বামী আজিজুল হক ও তাঁর বাবা হামিদুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে। অভিযুক্ত দুইজনই শাজাহানপুর থানা পুলিশেট হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন এরআগে রোববার বেলা ১১ টার দিকে বগুড়া শহরের উপকণ্ঠ বনানীর শুভেচ্ছা আবাসিক হোটেল থেকে আশামনি ও আব্দুল্লাহার গলাকাটা লাশ উদ্ধার করেন পুলিশ। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গত শুক্রবার শুভেচ্ছা হোটেলে এসে গ্রেপ্তার আজিজুল স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে একটি কক্ষ বুকিং দেন। এরপর বগুড়া শহর থেকে গরু জবাই করার চাকু কেনেন। কেনাকাটা করে দেওয়ার কথা বলে গতকাল শনিবার বিকেলে শ্বশুরবাড়ি থেকে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে শহরে বের হন আজিজুল। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে হোটেলে ওঠেন। রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে প্রথমে স্ত্রীকে বাথরুমে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করেন। এরপর শিশু সন্তানকে গলা কেটে হত্যা করতে গিয়ে দেহ থেকে মাথা আলাদা হয়ে যায়। পরে সন্তানের মাথা ব্যাগে ভরে হোটেলকক্ষে তালা দিয়ে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে বগুড়া শহরের ফতেহ আলী রেলসেতু থেকে করতোয়া নদীতে ফেলে দেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। স্ত্রী-সন্তানকে হত্যার পর আজিজুল হক শ্বশুরবাড়িতে ফিরে স্ত্রী-সন্তানকে হারানোর মিথ্যা নাটক সাজান। তিনি শ্বশুরকে সঙ্গে নিয়ে রাতভর শহরে খোঁজাখুঁজি করে থানায় অভিযোগ নিয়ে যান। রোববার সকালে স্ত্রী-সন্তানের সন্ধান চেয়ে শহরে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করেন বলে স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। পরে বেলা ১১ টার দিকে আবাসিক হোটেলের ভাড়া পরিশোধ করতে আজিজুল হোটেলে গেলে তাঁর কথাবার্তায় কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়। পরে তাঁকে আটক করে হোটেল কর্তৃপক্ষ থানা পুলিশ কে খবর দেন। ঘটনাস্থলে
পুলিশ এসপ তাঁকে হেফাজতে নেয়। একপর্যায়ে আজিজুলে স্বীকারোক্তি অনুযায়ী হোটেলটির ৩০১ নম্বর কক্ষ থেকে তার স্ত্রী ও সন্তানের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করেন। তবে এখনও শিশু আব্দুল্লাহার কাটা মাথা উদ্ধার সম্ভব হয়নি। গতকাল রোববার রাজশাহী থেকে আসা ডুবুরিদল করতোয়া নদীতে গ্রেপ্তার আজিজুলের দেখানো জায়গায় অভিযান চালিয়েও ব্যর্থ হয়। আজ সোমবার সকাল ১১ টা থেকে আবারও শিশুটির কাটা মাথা উদ্ধারে অভিযান শুরু করে। এ বিষয়ে
শাজাহানপুর থানার ওসি শহিদুল ইসলাম জানান গ্রেপ্তারকৃত আজিজুল ও তাঁর বাবা হামিদুল ইসলামকে আজ আদালতে সোপর্দ করা হবে৷ এছাড়াও শিশুটির কাটা মাথা উদ্ধারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।স্ত্রী-ছেলেকে হত্যা করে আজিজুলের নিখোঁজ নাটক হোটেল কক্ষ ভাড়া নিয়ে স্ত্রী ও সন্তানকে নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যার পরও থামেনি ঘাতক আজিজুল হক। ১ বছর বয়সী ছেলে আবদুল্লাহ আল রাফির শরীর থেকে মাথা কেটে ব্যাগে ভরে সাত কিলোমিটার দূরে করতোয়া নদীতে ফেলে দেয়। জোড়া খুনের পর নিজেই সাজে সাধু। মঞ্চস্থ করে স্ত্রী-সন্তান নিখোঁজ নাটক! খুনের আগে স্ত্রী-ছেলের সঙ্গে ছবিও তোলে। তিনজনের সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে গতকাল রোববার সকালে আজিজুল লেখে, ‘আমার স্ত্রী ও সন্তান নিখোঁজ’। তবে বেশি দূর এগোতে পারেনি কুশীলব সেনাসদস্য আজিজুল। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে হত্যার দায়ও স্বীকার করেছে। মর্মস্পর্শী ঘটনাটি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার। গতকাল মা-ছেলের লাশ শাজাহানপুরের শুভেচ্ছা আবাসিক হোটেলের ৩০১ নম্বর কক্ষ থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে রাফির খণ্ডিত মাথার খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি। গ্রেফতারকৃতআজিজুল ধুনট উপজেলার কালেরপাড়া ইউনিয়নের হেউটনগর গ্রামের হামিদুর রহমানের ছেলে। তার নিহত স্ত্রী আশামণি (২০) বগুড়া সদরের আকাশতারা এলাকার আসাদুল ইসলামের মেয়ে।
যেভাবে হত্যা করা করা হয় আশামণি ও তার একমাত্র ১ বছর বয়সী সন্তান আবদুল্লাহ আল রাফির।
গেল শনিবার বিকেলে ৭০০ টাকায় শাজাহানপুরের ওই হোটেল কক্ষ ভাড়া নেয় আজিজুল। রাত সাড়ে ৮টার দিকে দু’জনকে গলা কেটে হত্যার পর স্ত্রীর লাশ বাথরুমে রাখে। এক পর্যায়ে ছেলের মাথা কেটে ব্যাগে ভরে। পরে মাথাহীন দেহ খাটের নিচে রেখে হোটেল থেকে বের হয়ে যায় আজিজুল। এর পর রাফির খণ্ডিত মাথা শহরের করতোয়া নদীতে ফেলে ছোটে শ্বশুরবাড়ির দিকে। এর পর শুরু হয় আজিজুলের নাটক। রাতেই শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সে জানায়, আশামণি ও রাফিকে ইজিবাইকে তুলে দিয়েছে এখানে আসার জন্য। এরপর তাদের খোঁজ পাচ্ছে না। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার কথা আমলে নিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। রাতভর খুঁজে না পেয়ে আজিজুলকে নিয়ে তাঁর শ্বশুর সদর থানায় জিডি করতে যান। গ্রেফতারকৃত আজিজুল জিডি করতে না চাইলে শ্বশুর বাদী হয়ে গতকাল সকাল ১০টার দিকে জিডি করেন। পাশাপাশি শহরে করা হয় মাইকিং। এদিকে আজিজুল শনিবার রাতে না ফিরে পরদিন হোটেলে ফিরলে সেখানকার লোকজনের সন্দেহ হয়। এক পর্যায়ে থানায় খবর দিলে পুলিশ এসে তাকে আটক করে। পরে হোটেল কক্ষ তল্লাশি করে আজিজুলের স্ত্রী ও সন্তানের লাশ দেখতে পায়। এক পর্যায়ে পুলিশের জেরার মুখে সে হত্যার কথা স্বীকার করে। পরে আজিজুলকে নিয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের একটি দল শিশুটির মাথা খুঁজতে করতোয়া নদীতে যায়। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মাথার খোঁজ মেলেনি। জোড়া হত্যার পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব শাখা। খবর দেওয়া হয় সিআইডির সিরাজগঞ্জের ক্রাইম সিন টিমকে। সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ আলাদাভাবে কাজ শুরু করেছে। বিকেলে ক্রাইম সিনের কাজ শেষ হলে লাশ দুটি বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ মর্গে নেওয়া হয়। সিআইডির ইন্সপেক্টর মঞ্জুর মওলা জানান সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে লাশ দুটি মর্গে নেয় পুলিশ। শিশুটির খণ্ডিত মাথা উদ্ধারে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বগুড়ায় পৌঁছে নদীতে নামে রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস। হোটেল ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম বলেন, শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে খুন করে ৯টায় হোটেল ছাড়ে আজিজুল। তার মতিগতি দেখে সন্দেহ হয়েছিল– কোনো একটা অপরাধ সে করেছে। হত্যার কথা স্বীকার
আজিজুল জবানবন্দিতে পুলিশকে জানিয়েছে, তার অনুপস্থিতিতে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে স্ত্রী। বিষয়টি তার মা-বাবাও জানেন। তারা আশামণিকে শাসনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। আজিজুলও ব্যর্থ হয়ে খুনের পরিকল্পনা করে। যৌতুকের বিষয়টি আজিজুল অস্বীকার করেছে। সন্তান কী দোষ করেছে– এ বিষয়ে আজিজুল পুলিশকে বলে, স্ত্রী বেঁচে নেই; সন্তান বেঁচে থাকবে কার আশায়? তাই তাকেও খুন করে ফেলি। আজিজুল যে চাকু দিয়ে গলা কাটে, সেটি শনিবার বিকেলেই শহরের রেলঘুণ্টি এলাকার একটি দোকান থেকে কিনে ব্যাগে ভরে রাখে। বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ (সদর সার্কেল) সরাফাত ইসলাম সাংবাদিকদের জানান এ ঘটনায় শাজাহানপুর থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। এখন প্রকৃত খুনের কারণ জানতে হবে। নিশংস এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত গ্রেফতারকৃত আজিজুলের বাড়ির লোকজন লাপাত্তা। হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে আজিজুলের মা-বাবাসহ পরিবারের সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। স্থানীয় কালেরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য রকিবুল ইসলাম বলেন আজিজুলের পরিবারের লোকজন খুনের খবর হয়তো আগেই জানতে পেরেছেন। তাই তারা আগেভাগেই পালিয়েছেন। আমরা আজ দুপুর বেলায় জানতে পারি। আশামণির পরিবারের দাবি আশামণির বাবা আসাদুল ইসলাম শহরের ফতেহ আলী বাজারের ফলের দোকানের কর্মচারী। একমাত্র মেয়ে ও নাতির নির্মম খুনের সংবাদে তিনি অঝোরে কাঁদছেন। আশামণির মা গোলাপি বেগম এখন শোকে পাথর। আসাদুলের দাবি, আজিজুল বিয়ের সময় শহরে তিন শতক জমি চেয়েছিল। জমির বদলে এক বছর আগে এক লাখ টাকা দেন। বাকি টাকার জন্য প্রায়ই তাঁর মেয়েকে নির্যাতন করত। হত্যার আগের দিন শ্বশুরবাড়িতেও টাকা কিংবা জমির জন্য বকাঝকা করে আশামণিকে। না দিলে পরিণতি খারাপ হবে বলেও হুমকি দেয়। এক পর্যায়ে শনিবার মেয়েকে বাড়ি থেকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে খুন করে।
Print [1]