ডেইলী নিউজ বাংলা ডেস্ক , আপলোডের সময় : সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪ , আজকের সময় : বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

যেভাবে হিরোইন প্রবেশ করছে বাংলাদেশে-নেপথ্যে কারা?

যেভাবে হিরোইন প্রবেশ করছে বাংলাদেশে-নেপথ্যে কারা?

 

রাজশাহী ব্যুরো: দেশের সর্ববৃহৎ নদী পদ্মা, এদেশে প্রবেশে করেছে গোদাগাড়ীর কোলঘেঁসে। যার কারনে এই অঞ্চল দিয়ে মাদক পাচারের ঘটনা অনেক পুরোনো। রাজশাহী জেলার চর আষাঢ়িয়াদহ , চাঁপাইনবাবগঞ্জের চর আলাতুলী ও শাজাহানপুর এই তিনটি ইউনিয়ন মাদক পাচারের এক অভয়নগর হিসেবে গড়ে উঠেছে।

গত কয়েক সপ্তাহের অনুসন্ধানে দেখা গেছে গোদাগাড়ী চরাঞ্চলের মানুষের পারাপারের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌকা। আর এই নৌকাতেই পার হচ্ছে ভয়াবহ মাদক। সরকারকে মোটা অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে একটি চক্র এই খেয়াঘাটকে ইজারা নিচ্ছেন মাদক পাচারের জন্য।

অন্যদিকে কৃষক ও সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলছে ঘাটের ইজারাদাররা। যা গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত। ঘাট ইজারার কারনে চরাঞ্চলের কৃষকদের ফসল উৎপাদনের পর বাজারজাত করতেও গুনতে হচ্ছে দ্বিগুন খরচ।

গোদাগাড়ী অঞ্চলের ঘাট গুলোর খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পারাপারের জন্য ঘাটের ভাড়া দিতে হয় মাথা প্রতি ৫ টাকা। আর ফসলের জন্য দিতে হয় বস্তা/ক্যারেট প্রতি ১৫-১৮ টাকা। ঘাটগুলোর ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছরের ঘাটের ইজারা মূল্য তিনগুন বেশি টাকায় নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে টাকা দিয়ে ঘাটগুলো ইজারা নেওয়া হয়েছে মানুষ ও পণ্য পারাপার করে অর্ধেক টাকাও উঠার কথা নয়!!

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, নদী বা ঘাট পারাপারের জন্য প্রতি প্যাকেট হিরোইন (১শত গ্রাম) ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। এর মধ্যে ঘাট ইজারাদার ৩ হাজার ও নৌকা মাঝি ২ হাজার টাকা নিয়ে থাকে। আর প্রতি পিছ ফেনসিডিলের জন্য দিতে হয় ১০ টাকা। ১শত বোতলের বস্তার জন্য মাঝিকে দিতে হয় ২ হাজার টাকা। পদ্মার দুই পারের হিরোইন ব্যবসায়ী ও মাঝিদের নিয়ে গড়ে উঠেছে মাদকের ভয়াবহ সিন্ডিকেট।

২০১৬ সালে ফেনসিডিল পারাপারের সময় হাতেনাতে একজন পাচারকারি গ্রেফতার হন। সেই দিন পাচার চক্রের অন্যতম হিসেবে বিপ্লব ঘাটিয়ালের বিরুদ্ধে ৪৯৪ বোতল ফেনসিডিলের মামলা হয়। যার মামলা নাম্বার ১৬১৬ গোদাগাড়ী। সেই মামলা এখনও চলমান রয়েছে। বিপ্লব সিন্ডিকেটের আরেক মাঝি লিটন।

বছরের নভেম্বর ৩০ তারিখে ১ কেজি ১শত গ্রাম হিরোইনসহ গ্রেপ্তার হয় র‍‍্যাবের হাতে। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে। মাদক উদ্ধারকারি সংস্থা ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, গোদাগাড়ী উপজেলার অনেকেই মাদকের সঙ্গে জড়িত। তাদের ভাষ্যমতে, শুধু গোদাগাড়ীতেই মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন প্রায় ৫০০ জন। এদের বেশির ভাগ মাদক ব্যবসায়ী রাজনৈতিক ছত্র-ছায়াই রয়েছে। এমনকি বড় ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করলেও রাজনৈতিক প্রভাবে তাদের ছাড়তে বাধ্য হয় প্রশাসন।

মাদক ও মাদক সংশ্লিষ্টের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে গেলে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে প্রতিবেদকের। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাদকের পাচারের শুরু হয় ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে। এরপর সোজা বহরমপুর হয়ে লালগোলা, ভগবানগোলা হয়ে সিমান্ত এলাকা চর লবনগোলা, বিনপাড়া সব্দুলপুর, আষাড়িয়াদহ, কানাপাড়া হয়ে সিমান্তের তারকাটা (তারের বেড়া) পর্যন্ত পৌছে দেয় মুর্শিদাবাদ লালগোলা এলাকার কাশেম, কবির, সেলিম ও আনারুল গ্রুপের সদস্যরা। এরপর তারকাটা পার হলেই দ্বায়িত্ব পড়ে এদেশের অর্থাৎ গোদাগাড়ী চরাঅঞ্চলের কয়েকটি গ্রুপের। এই পাচার চক্রের মধ্যে অন্যতম রফিক, চর কানাপাড় সুনারুল, হালিম, সাইদুল, মিঠুন, এবাদুল, উজ্বল, বাবু, চর নওসারা ৪৬ পাড়ার পিয়ারুল, ফারুক, ৫২৩ এলাকার সাবু, কোদালকাঠি’র শরিফুলসহ আরও অনেক গ্রুপ রয়েছে। তবে বর্তমানে প্রেমতলী, বিদিরপুর ও ফুলতলা ঘাটে মাদক নিয়ন্ত্রণ করছে গোদাগাড়ী পিরিজপুর বাগানপাড়ার ইমন আলী ও চর আমতলা এলাকার গোলাম মর্তুজা। আর এদের হয়ে কাজ করছে চর আমতলা এলাকার নাঈম শাহ মাঝি, শামীম মাঝিসহ আরও কয়েকজন রয়েছে। লাইন ও পার্টি ঠিক থাকলে নদী পার হয়ে আসবে আসল ব্যবসায়ীদের হাতে।

মাদক সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুসারে ২৫-৩০ লক্ষ (কোয়ালিটি ভেদে) টাকা মূল্যে ভারত থেকে কেজি কেজি হিরোইন নিয়ে আসে ব্যবসায়ীরা। সেই হিরোইন বাংলাদেশে প্রবেশের পর সেটি ১শত গ্রামের প্যাকেট করা হয়। এরপর পাইকারি বিক্রি করা হয় ৪০-৫০ লক্ষ টাকায়। আবার প্রকার ভেদে এর দাম বেশি হতে পারে। তাদের ভাষ্যমতে, গোদাগাড়ী এলাকার বড় ব্যবসায়ীরা হলেন মহিষালবাড়ি (রামনগর) এলাকার মাহাবুর রহমান ওরফে মাহাবুর কানা, মাদারপুর (ডিমভাঙ্গা) এলাকার ঈসাহাক ওরফে ল্যাংড়া ইসাহাক, বড় তারেক , তারেক বাবু, হানিফ, মনির কাউন্সিলরসহ তার তিন ভাই, মহিষালবাড়ি মহিউদ্দিন কলেজ পাড়ার বিপ্লব, মহিষালবাড়ি শিবসাগর এলাকার কামরুজ্জামান রনি, মহিষালবাড়ি এলাকার তোফায়েল, মোত্তাসিন, শামীম হোসেন ওরফে ঝাপু, রুহুল চৌকিদার, কোদালকাটি এলাকার শীষ মোহাম্মদসহ অসংখ্য মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। এরপর এই ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

আশ্চর্যের বিষয় হলো এদের কারো কারো বিরুদ্ধে মাদকের কোন মামলা পর্যন্ত নেই। এদের মধ্যে অন্যতম মাদারপুরের তারেক। তারেক মাত্র ৮ বছরে আগেও মানুষের দোকানের কর্মচারি ছিল। রূপকথার সেই আলাউদ্দিনের চ্যারাগের মত হঠাৎ মাদকবাতির বদৌলতে সে এখন শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মাদকের ব্যাপারে স্থানীয়দের সাথে কথা বললে তাদের দাবি, গোদাগাড়ীর প্রতিটি ঘাটে (নদীর দুই পারে) ২৪ ঘন্টা প্রশাসনের নজরদারি থাকলে, পরিবার ও সমাজ ধংসকারি মাদক এদেশে প্রবেশ করতে পারবে না। প্রশাসন চাইলে নদীর দুইপারে প্রতিটি ঘাটে পুলিশ মোতায়েন করতে পারেন।

মাদক পাচারের ব্যাপারে ইমন ঘাটিয়ালের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি সকল বিষয় অস্বীকার করেন এবং সাংবাদিককেই উল্টো ব্ল্যাকমেইলিং করে বসেন। তার দাবি, নিউজ প্রকাশ হলে প্রতিবেদক কার থেকে টাকা নিয়েছে, এমন কল রেকর্ডের কথা বলে প্রতিবেদককে নিউজ প্রকাশ করতে ভয়ভীতি দেখান। নিউজ প্রকাশ করলে প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে প্রেসক্লাব গঠন করবে, সংবাদ সম্মেলন করবে বলে হুমকি দেন এই মাদক পাচারকারি। তার দাবি, তিনি দীর্ঘ ৩ বছর যাবত রাজশাহী শহরে একটি ফ্ল্যাট বাসায় ভাড়া থাকেন। তিনি পাচার চক্রের সাথে জড়িত না।

এদিকে আইন শৃংখলা রক্ষাকারি বিভিন্ন বাহিনী বলছে, প্রতি মাসে মাদক বিরোধী অভিযানে তিন শতাধিক মামলা হয়। মাদকের তথ্যানুসন্ধান নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর রাজশাহীর উপ-পরিচালক আলমগীর হোসেনের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমরা রাত দিন এক করে মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের লোকবল সংকট থাকলেও অভিযান অব্যাহত থাকে। প্রতিমাসে শতাধিক মামলা দিয়ে থাকি। মাদক ব্যবসায় তিনগুন লাভ হওয়ার কারনে তারা জীবনের ঝুকি নিয়ে রাতের আঁধারে এগুলো প্রবেশ করে থাকে। তবে মাদকের ব্যাপারে শুধু আমরা নয়, পুলিশ, র‍‍্যাব, বিজিবিসহ অন্যান্য সংস্থাও কাজ করছে। এব্যাপারে পুলিশ সুপার রাজশাহীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান সব সময় হচ্ছে। মাদকের ব্যাপারে কোন ছাড় নয়, যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন তথ্য পেলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা হয় এবং হবে।