দৌলতপুর (কুষ্টিয়া): নানা কারণেই আলোচিত কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আক্তারের বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ উঠেছে। এ উপজেলায় যোগ দেয়ার প্রথমের দিকে সীমিত চাহিদায় তুষ্ট থাকলেও তিনি এই প্রথমবারের মতো ‘হট চেয়ারে’ বসার সুযোগ পেয়ে কিছুদিন যেতে না যেতেই অবৈধ অর্থের প্রতি প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেন। এমন কোনো খাত বাকি নেই যেখানে হাত দেননি তিনি। গত পৌনে তিন বছরে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে একের পর এক নানামুখী অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। গত কয়েকদিনের অনুসন্ধানে ইউএনও শারমিন আক্তারের ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ ও স্বেচ্ছাচারিতাসহ কথায় কথায় মানুষকে মোবাইল কোর্টে শায়েস্তা করার হুমকি দেয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
ইউএনও শারমিন আক্তার দুইবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ফিরে এসেছেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে। তারপরেও একটুও ফেরেনি তার হুঁশ। এখনো সমানে খেয়ে যাচ্ছেন কমিশনের নামে বেশুমার ঘুষ। দৌলতপুরবাসী তার এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডকে ঘৃণার চোখে দেখছেন। তিনি এখানকার মানুষের কাছে ‘কমিশন আপা’ হিসেবে এক নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছেন। তবে উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা হওয়ায় অনেকে ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না। শারমিন আক্তার দৌলতপুরের প্রথম নারী ইউএনও হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ঠিকই। তবে তার চেয়েও বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন একজন নারী কর্মকর্তা হয়েও দুর্নীতিতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার কারণে। এ উপজেলার ইতিহাসে এ রকম ইউএনও আগে কখনো দেখেননি কেউ। তিনি ইতোপূর্বের সব ইউএনওকে টপকে নজিরবিহীনভাবে কমিশনের নামে ঘুষ বাণিজ্যে লিপ্ত হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দের বিপরীতে দুই পার্সেন্ট করে কমিশন বা ঘুষ ইউএনও শারমিন আক্তারকে না দেয়া হলে তিনি কোনো ফাইলই স্বাক্ষর করেন না। আগে কমিশনের টাকা বুঝে নিয়ে তারপরে ফাইলে হাত দেন তিনি। কোনো জাতীয় দিবস ও সরকারিভাবে অন্যান্য দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে ইউএনওর পোয়াবারো অবস্থা দেখা দেখা দেয়। এসব সরকারি দিবস পালনের নামে বিভিন্ন ইটভাটা, ইন্ডাস্ট্রিজ ও সরকারি, বেসরকারি দপ্তরসমূহ থেকে তিনি নিজেই চাঁদা আদায়ে লেগে পড়েন। নামে মাত্র খরচ দেখিয়ে সেসব টাকা আত্মসাৎ করেন। নিয়ম অনুযায়ী উপজেলা পরিষদের সমন্বয় কমিটির সভা কিংবা পর্যালোচনা সভায় আয়-ব্যয়ের হিসেব উপস্থাপন করার কথা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি তা উপেক্ষা করে আসছেন। তিনি একের পর এক ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ টাকার পাহার গড়ে তুলেছেন। অবৈধ অর্থের লোভ সংবরণ করতে না পারায় তিনি এখানকার মানুষের কাছে চরমভাবে ধিকৃত ও ঘৃণীত হয়ে উঠেছেন। কয়েকদিন ধরে অনুসন্ধানকালে অসংখ্য মানুষের সাথে কথা হয়, কিন্তু একটি মানুষকেও ইউএনও শারমিন সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বলতে শোনা যায়নি। বরং তার প্রতি জনরোষ লক্ষ্য করা গেছে। সবাই তাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য এমনকি গালাগাল পর্যন্ত করে তার বিরুদ্ধের অভিযোগ সুষ্ঠু তদন্ত করে উপযুক্ত শাস্তি দাবি করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দৌলতপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক একজন ভাইস চেয়ারম্যান জানান, তিনি বছর দুয়েক ইউএনও শারমিন আক্তারকে পেয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে তার যেসব প্রকল্প ছিল সবগুলোতেই কমিশন খেয়েছেন ইউএনও। উপজেলা প্রকৌশলী অফিসের হিসাব রক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) শহিদুল ইসলামের মাধ্যমে যতগুলো ফাইল স্বাক্ষরের জন্য ইউএনওর কাছে পাঠানো হয়েছে একেকটি ফাইল প্রতি ৫ হাজার টাকা নিয়েছেন ইউএনও। তিনি আরো জানান, কোনো একদিন একটি ফাইল স্বাক্ষরের জন্য পাঠানো হলেও কমিশনের টাকাটা পরে দেয়ার কথা জানানোয় ইউএনও শারমিন সেই ফাইলে হাত দেননি। ফিরিয়ে দিয়েছেন। পরে টাকা ম্যানেজ করে দেয়া হলে তবেই সেই ফাইলে স্বাক্ষর করেন তিনি। ওই ভাইস চেয়ারম্যান ইউএনওকে কঞ্জুজ ছোটলোক বলে মন্তব্য করেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দপ্তরের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত দপ্তর হচ্ছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) দপ্তর। গত পৌনে তিন বছরে ইউএনও শারমিন আক্তার পিআইওর দপ্তর থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের ফাইল স্বাক্ষর করতে অন্তত ৩০ থেকে ৩২ লাখ টাকা কমিশন গ্রহণ করেছেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বর্তমান পিআইও আব্দুল হান্নান এখানে যোগ দেয়ার প্রায় ৯ মাসে বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে ইউএনও ১০ লাখ টাকার ওপরে কমিশন নিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি পিআইও আব্দুল হান্নান। উপজেলা ভূমি অফিসের সাথে মাসিকভিত্তিতে ইউএনওর মোটা অঙ্কের টাকার চুক্তি রয়েছে বলেও সূত্রটি নিশ্চিত করেছে। উপজেলা খাদ্য গোডাউনে ধান, চাল, গম সংগ্রহ অভিযানে যে সিন্ডিকেট রয়েছে সেই সিন্ডিকেট থেকে নির্ধারিত কমিশন খেয়ে আসছেন ইউএনও। একইভাবে কমিশন খাচ্ছেন এলজিইডির বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে। উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে কৃষকদের প্রণোদনা প্যাকেজের পণ্য পরিবহন বিলের টাকাও গিলেছেন তিনি। উপজেলা মডেল মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণের স্থানে যেসব বড় বড় গাছ ছিল সেগুলো এই আলোচিত ইউএনও সাবাড় করে দিয়েছেন বলে ওই সূত্রটি জানিয়েছে।
অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাড়ি নির্মাণ প্রকল্পের বাড়ি পেতে এ উপজেলার ২ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা আবেদন করেন। তাদের মধ্যে ৭০ জনকে চূড়ান্ত তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের এই বাড়ি নির্মাণ প্রকল্পে আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত পর্যন্ত ইউএনও শারমিন আক্তার বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদন ফরম জমা নেয়ার সময়ই ইউএনওর নির্দেশে অফিস স্টাফ জাহাঙ্গীর হোসেন ও মহসিন আলী একেকজনের কাছ থেকে ৪-৫ হাজার টাকা করে আদায় করেন। আবেদনকারী এই ২ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে যাচাই বাছাইয়ে ৭০ জনের নাম চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যারা পাবেন সাড়ে ১৫ লাখ টাকা থেকে প্রায় ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ের বাড়ি। চূড়ান্ত তালিকাভুক্ত ৭০ জনের মধ্যে প্রায় ১০ জনের মতো স্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। তাদের দোতলা বাড়িসহ বিল্ডিং বাড়ি রয়েছে। তাদের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা করে উৎকোচ গ্রহণ করেছেন ইউএনও। তালিকাভুক্ত অন্যদের কাছ থেকেও এক থেকে দেড় লাখ টাকা করে আদায় করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের দুই নেতার মাধ্যমে ইউএনও এসব টাকা গ্রহণ করেন বলে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তালিকাভুক্ত স্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দৌলতপুর সদর ইউনিয়নের দাড়পাড়া গ্রামের আফসার আলীর দোতলা বাড়ি রয়েছে। উপজেলা পরিষদের সামনের এলাকা বাজারপাড়ার সোহরাব হোসেন, মানিকদিয়াড় গ্রামের আওরঙ্গজেব, বোয়ালিয়া গ্রামের আব্দুল বারীসহ অন্তত ৮-১০ জনের বিল্ডিং বাড়ি রয়েছে। অথচ যাদের জন্য এসব সরকারি বাড়ি নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে সেই অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারাই ইউএনওর দাবি করা টাকা দিতে না পারার কারণে বাড়ি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যারা অপেক্ষাকৃত বেশি টাকা দিতে পেরেছেন কেবল তারাই (৭০ জন) এই প্রকল্পের আওতায় আসার সুযোগ পেয়েছেন। উপজেলার রামকৃষ্ণপুর সীমান্ত এলাকার অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা মাহাতাব উদ্দিনের কাছে তালিকাভুক্তির জন্য দুই লাখ টাকা দাবি করা হয়। কিন্তু তিনি ঘুষ দিয়ে বাড়ি নিতে রাজি হননি বলে জানিয়েছেন। বোয়ালিয়া গ্রামের আবু তাহের নামে এক অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা টাকা দিতে না পারায় তাকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। পরে তিনি তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে অাপিল করেন।
এমন কোনো খাত বাকি নেই যেখানে হাত দেননি শারমিন আক্তার। তার নজর পড়েছে কোথায় কীভাবে অবৈধ টাকা আয় করা যায় সব দিকেই। উপজেলার বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টারের একেকটির সাথে প্রতি মাসে আড়াই হাজার টাকার চুক্তি রয়েছে। দৌলতপুর হাসপাতাল এলাকার একটি ডায়গনস্টিক সেন্টারের বিল্ডিং মালিক মো. পারভেজ জানান, এসব টাকা না দেয়া হলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জেল-জরিমানার হুমকি দেন উপজেলা প্রশাসনের এই প্রধান কর্মকর্তা। মো. পারভেজ আরো জানিয়েছেন, তার বাড়ির পাশে রাস্তা নির্মাণ নিয়ে একটি জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় ইউএনও তার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বাড়িটি সিলগালা করে দেয়ার পাশাপাশি ৫ লাখ টাকা জরিমানা করার হুমকি দিয়ে আসেন। পারভেজ বলেন, রাস্তার বিষয়ে আদালতে মামলা হয়েছে। বিচারাধীন মামলাটিতে আদালত থেকে যে রায় দেয়া হবে সেটাই মেনে নেব। কিন্তু ইউএনওকে কোনো টাকা দেব না।
একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, ‘এ দেশে কেউ গৃহহীন থাকবে না’ এমন ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণের যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর এই প্রকল্পেও ইউএনওর কালো হাতের থাবা পড়েছে। শারমিন আক্তার তার দপ্তরের অফিস সহকারী ওসমান আলীর অার্থিক সুপারিশে উপজেলার চরদিয়াড় গ্রামে এক স্বচ্ছল ব্যক্তিকে গৃহহীন সাজিয়ে তার নামে ‘দুর্যোগ সহনীয় গৃহ নির্মাণ’ প্রকল্পের বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছেন। আর ২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা ব্যয়ের এ বাড়ির জন্য ইউএনও নিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর স্থানীয় প্রতিনিধি হয়েও শারমিন আক্তার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেই চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন বলে অনেকে মন্তব্য করেন।
এদিকে এখানকার কুয়েতভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা আল সালেহ লাইফ লাইনের পক্ষ থেকে মসজিদ, মাদ্রাসার পাশাপাশি গৃহহীনদের জন্য বাড়ি নির্মাণ করে দেয়ার যে প্রকল্প রয়েছে সেই প্রকল্পের আওতায় ইউএনও শারমিন তার আপন ননদের জন্য সাতক্ষীরায় বাড়ি করিয়ে নিয়েছেন। প্রায় তিন লাখ টাকা বরাদ্দের ওই বাড়িটি নির্মাণের শেষ দিকে এসে টিন কেনার অর্থ ফুরিয়ে যাওয়ায় সেই সামান্য টিনের জন্যেও আল সালেহ লাইফ লাইন কর্তৃপক্ষের কাছে হাত পাতেন ইউএনও। একটি উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা হয়েও নিজের আত্মীয়ের বাড়ি তৈরির জন্য সংস্থাটির গৃহহীন প্রকল্পে তাকে অন্তর্ভুক্ত করার এ ঘটনাটি ইউএনওর কাছে স্বাভাবিক ঘটনা মনে হলেও অনুসন্ধানকালে এই প্রতিবেদককেই লজ্জাজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এই একটি ঘটনার মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়ে ওঠে অর্থলোভী ইউএনওর মানসিকতা ও ব্যক্তিত্ব।
দৌলতপুর থানা বাজারের পাশের এলাকায় অবস্থিত শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল আজম বিকো জানান, ২০১৬ সালে মাওশির পরিদর্শন টিমের রিপোর্টে কলেজটির ৩০ জন শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। পরে চক্রান্তমূলকভাবে তাদের মধ্যে ৮ জনের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ইউএনওর কাছে ২২ জনের নামের তালিকা দেয়া হয়। ইউএনও শারমিন আক্তার তদন্ত ছাড়াই এই ইস্যুকে পুঁজি করে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন এবং ২২ জনের নামের তালিকায় স্বাক্ষর করে তা অনুমোদনের জন্য মাউশিতে পাঠান। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ পুনরায় মাউশির কাছে বিষয়টি তদন্তের আবেদন করেন। এরপর মাউশির পরিদর্শন টিম পুনঃতদন্ত করে আগের ৩০ জনের নাম পুনর্বহাল রাখেন। মাঝখান থেকে ইউএনও ৫০ হাজার টাকা হজম করে ফেলেন। এ ছাড়া কলেজটি দেখভাল করার জন্য সরকারিভাবে ইউএনওকে লিখিত দায়িত্ব দেয়া হলেও তিনি একদিনের জন্যেও কলেজ পরিদর্শনে যাননি বলেও কলেজটির শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল আজম বিকো জানিয়েছেন। অন্যদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্কুল শিক্ষক জানান, বিভিন্ন স্কুলের কমিটি গঠন সংক্রান্ত চিঠিতে স্বাক্ষর করার জন্য সেই চিঠি প্রতিও দুই হাজার টাকা করে নেন ইউএনও।
পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের সাথেও রয়েছে ইউএনওর অার্থিক বোঝাপড়া। পদ্মাকে রক্ষার জন্য সম্প্রতি অর্থলোভী ইউএনও শারমিন আক্তারের অপসারণ দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন চরাঞ্চলবাসী। ওই সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ইউএনওকে ম্যানেজ করে পদ্মা থেকে বালু তোলা হচ্ছে। বালু তোলার কারণে নদী রক্ষা বাঁধ ও নদী তীরবর্তী এলাকা হুমকির মুখে পড়ছে। বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো হলে তারা দুয়েকটি অভিযান চালিয়ে শুধুমাত্র আইওয়াশ করেছে। অভিযানের পরপরই আবার পুরোদমে বালু তোলা শুরু হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আলী বলেন, ইউএনও অভিযানে আসার আগেই বালু খোরদের কাছে খবর পৌঁছে দেয়া হয়। এর ফলে তারা সতর্ক হয়ে যায়। ইউএনওর সাথে তাদের অার্থিক চুক্তি থাকায় বালু উত্তোলন বন্ধ করা যাচ্ছে না।
অনুসন্ধানী তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালের এ বছরে স্বাধীনতা দিবসের কোনো অানুষ্ঠানিকতা না থাকলেও দিবসটি উপলক্ষে ইউএনও শারমিন আক্তার তার চাঁদার তালিকাভুক্তদের কাছ থেকে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা আদায় করেছেন। করোনার কারণে অনেকে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাদের মোবাইল কোর্টের হুমকি দিয়ে জোর করে এসব টাকা নেন। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের উপহার দেয়ার জন্য মাত্র ৬০ হাজার টাকা দিয়ে মগ কেনেন। আনুষঙ্গিক মিলিয়ে অনুৎযাপিত ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসে সাকুল্য ৭০ হাজার টাকা বেশি ব্যয় করেননি তিনি। বাকি টাকার হিসেব রেজিস্ট্রারভুক্ত না করে আত্মসাৎ করেন ইউএনও। গেল ১৬ ডিসেম্বর সীমিত আয়োজনে বিজয় দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রেও ইউএনও ৩ লক্ষাধিক টাকা চাঁদা আদায় করেছেন। কিন্তু সব মিলিয়ে এই বিজয় দিবসে ১ লাখ টাকাও ব্যয় হয়নি। উত্তোলিত বাকি টাকার পুরোটাই তিনি আত্মসাৎ করেছেন।
নাম প্রকাশ করা যাবে না এই শর্তে অপর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দিন (২৯ ডিসেম্বর ২০১৮) রাত ১০টার পর দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তারের সরকারি বাসভবনে যান একজন প্রার্থীর চার প্রতিনিধি। তাদের মধ্যে তিনজন গেটের বাইরে অবস্থান করেন। একজন ভেতরে গিয়ে একটি ব্যাগে করে ১৫ লাখ টাকা ইউএনও শারমিনের হাতে পৌঁছে দিয়ে আসেন। এ ছাড়া সবশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে ইউএনও শারমিন আক্তার ১০ লাখ টাকা গ্রহণ করেন বলে সূত্রটি এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্র মতে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে গত পৌনে তিন বছরে প্রায় দুই কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেছেন উপজেলা প্রশাসনের এই গুণধর শীর্ষ কর্মকর্তা।
দ্বিধাহীনভাবে সাধারণ মানুষের সাথে দুর্ব্যবহারকারী ইউএনও শারমিন আক্তারের স্বেচ্ছাচারিতার কবলে পড়েছেন এখানকার সাংবাদিক সমাজের বিরাট একটি অংশ। পৌনে তিন বছরে পূর্বের বাই রোটেশন সিস্টেম উপেক্ষা করে তিনি সরকারি বিজ্ঞাপন বণ্টনে একতরফানীতি বাস্তবায়ন করে স্বেচ্ছাচারিতার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তিনি নিজের পছন্দ অনুযায়ী নির্দিষ্ট কয়েকটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছেন। যার মধ্যে একেবারেই অখ্যাত পত্রিকার নামও পাওয়া গেছে। আর উপজেলা প্রশাসনের যে কোনো অনুষ্ঠানে, কর্মসূচিতে ওই নির্দিষ্ট পত্রিকাগুলোরই স্থানীয় প্রতিনিধিদের (ইউএনওর অাজ্ঞাবহ) আমন্ত্রণ জানিয়ে আসছেন তিনি। এদিকে ঘুরে ফিরে একই পত্রিকায় বারবার বিজ্ঞাপন প্রদান করায় এ উপজেলায় কর্মরত বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকের প্রতিনিধিদের মাঝে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ লক্ষ্য করা গেছে।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার (৩১ ডিসেম্বর) রাতে মোবাইল ফোনে জানতে চাওয়া হলে দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আক্তার বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এ সময় কী কী অভিযোগ আছে জানতে চান তিনি। উল্লেখযোগ্য অভিযোগগুলো তাকে জানানো হয়। জবাবে খানিকটা ব্যাখ্যা করে বলেন এসব অভিযোগ সঠিক নয়, সব মিথ্যা। অভিযুক্ত কেউই নিজের দোষ স্বীকার করেন না, আপনিও এর বাইরে নন- এমন কথা বলা হলে জবাবে ইউএনও শারমিন আক্তার একরকম নীরব হয়ে যান। মোবাইলে কথার মাঝে তিনি একাধিকবার সরাসরি দেখা করে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য জানালে তা নাকচ করে দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, শারমিন আক্তার বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আরডিসি থেকে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল দৌলতপুরের ইউএনও হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। করোনার শুরুর দিকে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় তার বদলি অর্ডার হয়। আর সেখানকার ইউএনওর এখানে তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে সেই বদলি আটকে যায়। পরে কুমারখালীর ইউএনও অন্য উপজেলায় বদলি হয়ে যান। শারমিন আক্তার এখানেই থেকে যান। কিছুদিন পর শারমিন আক্তারকে যশোরের শার্শা উপজেলায় বদলি করা হলেও অজ্ঞাত কারণে সেটিও ঠেকে যায়। সর্বশেষ তথ্য বলছে, দৌলতপুরেই পূর্ণ মেয়াদ শেষ করে এডিসির পদোন্নতি নিয়ে এখান থেকে বিদায় নেয়ার টার্গেটে রয়েছেন তিনি। তবে করোনা দৌলতপুর উপজেলায় ইউএনওর জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনলেও দৌলতপুরবাসীর জন্য তা দুর্ভাগ্যজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।