প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কৃষি জমি ও বনজফলজ গাছ যাচ্ছে ইভাটার পেটে
মো.আককাস আলী,নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি: প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কৃষি জমি ও বনজফলজ গাছ যাচ্ছে ইটভাটার পেটে। দেখার কেউ নেই বলারও কেউ নেই। সূত্রমতে,নওগাঁর ১১ উপজেলায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ছাড়াই কৃষিজমি ও আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে ইটভাটা।
বাড়ছেস্বাস্থ্যঝুঁকি, ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন। দীর্ঘদিন ধরে এসব অবৈধ ইটভাটায় সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে, নষ্ট করা হচ্ছে কৃষি জমি, পুড়ে যাচ্ছে আশেপাশের ফসল, কালো ধোঁয়া বিপর্যয় ঘটাচ্ছে পরিবেশের। এসব দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের অজ্ঞাত কারণে তারা সম্পূর্ণ নীরব।
নওগাঁ জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের হিসাবমতে, নওগাঁর ১১ উপজেলায় ইটভাটা রয়েছে ২০৩টি। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেয়েছে মাত্র ছয়টি। বাকি ১৯৭টি ভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। ফলে তারা জেলা প্রশাসনের অনুমোদনও (লাইসেন্স) পায়নি। এরপরও এসব ভাটায় থেমে নেই ইট পোড়ানো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেলার ৯৭ শতাংশ ভাটায় অবৈধভাবে ইট পোড়ানো হলেও প্রশাসন কার্যত নীরব। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ছাড়াই নিয়ম না মেনে কৃষিজমি ও আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা এসব ভাটার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এতে একদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ ও ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৩ অনুযায়ী বসতি এলাকা, পাহাড়, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে না। কৃষিজমিতেও কোনো ইটভাটা বৈধ হিসেবে গণ্য হবে না। বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (বাপা) নওগাঁ জেলা শাখার সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আইনের তোয়াক্কা না করে আবাসিক এলাকা ও কৃষিজমিতে গড়ে উঠছে ইটভাটা।
এসব ভাটার ধোঁয়ায় ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও দেখা দিচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। এটা খুবই হতাশাজনক।’ সদর উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন,‘ভাটার মালিকেরা সবাই লাইসেন্স নবায়ন করতে চান।
কিন্তু বর্তমান ইটভাটা প্রস্তুত আইনের শর্ত পূরণ না হওয়ায় আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছে। অনেক ইটভাটার উন্নত প্রযুক্তির চিমনি থাকা সত্তে¡ও কৃষিজমি কিংবা বসতি এলাকায় ইটভাটা থাকায় পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে না। জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর নওগাঁ জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশগত ছাড়পত্র না থাকায় ২০১৮ সাল থেকে ১৯৭টি ইটভাটার মালিক তাঁদের ভাটার লাইসেন্স নবায়ন করতে পারেননি।
ফলে বৈধ ইটভাটা রয়েছে মাত্র ছয়টি। জেলায় সবচেয়ে বেশি ইটভাটা আছে মান্দা উপজেলায়। এই উপজেলার ৩৮টি ভাটার একটিরও পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। এরপরই বেশি ইটভাটা রয়েছে সদর উপজেলায়, ৩৫টি। এর মধ্যে মাত্র তিনটির পরিবেশগত ছাড়পত্র রয়েছে। আত্রাই উপজেলায় ১৬টি ইটভাটার মধ্যে পরিবেশগত ছাড়পত্র রয়েছে দুটির। নিয়ামতপুর উপজেলায় ছয়টি ইটভাটার মধ্যে একটির পরিবেশগত ছাড়পত্র রয়েছে।
এ ছাড়া বদলগাছি উপজেলায় ২৬টি, মহাদেবপুরে ২০টি, পতœীতলায় ১৭টি, ধামইরহাটে ২১টি, রাণীনগরে ১২টি, পোরশায় ১০টি ও সাপাহারে ২টি ইটভাটা রয়েছে। এসব উপজেলার কোনো ইটভাটারই পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। সদর উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের পাহাড়পুর, দিঘা মধ্যপাড়া, হরিরামপুর ও দাসকান্দি এবং নওগাঁর পৌরসভার বরুণকান্দি ও শালুকা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব গ্রামের বসতি এলাকার পাশে ও ফসলি জমির মাঠে চারদিকে ধোঁয়ার কুন্ডলী।
ইটভাটার চিমনির কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। পাহাড়পুর গ্রামে ১২০-১৩০টি পরিবারের বসবাস। ওই গ্রামের পশ্চিমে বসতি এলাকার প্রায় ১৫০ মিটার দূরেই মেসার্স বি বি সি ব্রিকস নামের একটি ইটভাটার পাশাপাশি দুটি চিমনি রয়েছে। ভাটার এক শ্রমিক বলেন, প্রতিদিন তাঁদের ভাটার দুটি চিমনিতে চার টন কয়লা পোড়ানো হয়। কয়লা দেওয়ার সময় জিগজ্যাগ থেকেও প্রথম ১ থেকে ৫ মিনিট কালো ধোঁয়া বের হবে।
আধা ঘণ্টা পর নতুন করে কয়লা দেওয়া হলে আবার পাঁচ মিনিট পর্যন্ত কালো ধোঁয়া বের হয়। এই গ্রামের কৃষক আবদুস সালাম বলেন, এবার শীত মৌসুমে দুই বিঘা জমিতে বাঁধাকপি ও ফুলকপির চাষ করেছিলেন। কিন্তু দুটি ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে অনেক গাছ মরে যায়। ভাটাগুলো হওয়ার পর এই মাঠে ধানের ফলনও ভালো হয় না। বসতবাড়ির আশপাশে লাগানো ফলের গাছগুলোতে ঠিকমতো ফলন আসে না।
মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর ইউনিয়নের চৌমাশিয়া গ্রামের বাসিন্দা জিয়াউল, মনসুর আহমেদ, সামসুদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন বলেন, চৌমাশিয়া গ্রামের ফসলি দুটি কৃষিজমির মাঠে ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এসব ইটভাটার কালো ধোঁয়ার কারণে ঠিকমতো নিশ্বাস নেওয়া যায় না। ভাটা হওয়ার পর থেকে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর নওগাঁ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মকবুল হোসেন বলেন, ‘অবৈধ ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসনে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। ম্যাজিস্ট্রেট না পাওয়ায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না।
নওগাঁর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক উত্তম কুমার রায় বলেন, গত বছর থেকে করোনার সংক্রমণের কারণে, অন্যদিকে কাজের চাপের কারণে ইটভাটায় অভিযান চালানোর জন্য নিয়মিত ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে আগামী দিনে অবৈধ ভাটাবিরোধী অভিযান নিয়মিত চালানো হবে।