বোয়ালমারী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি : ফরিদপুরের বোয়ালমারী চতুল ইউনিয়ন ভূমি অফিসে চুক্তি বা ঘুষ ছাড়া মিলছে না কোনো ভূমি সেবা। সম্প্রতি এমন অভিযোগ উঠেছে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। তাদের অতিরিক্ত অর্থ না দিলে মাসের পর মাস অফিসের টেবিলেই ফাইল পড়ে থাকে, আর চুক্তিতে গেলে দু’এক সপ্তাহে মেলে মিউটেশন। এমন অহরহ অভিযোগ ভূমি অফিসের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। জমির নামজারি (মিউটেশন), খতিয়ান দেখানো, খাজনা আদায় ও অনলাইনে খাজনার দেওয়ার আইডি খোলা প্রতিটি ধাপে টাকা না দিলে কাজ হয় না বলে অভিযোগ করেন সেবা প্রত্যাশীরা।
আর এসব কাজে মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন বিভিন্ন কম্পিউটার দোকান এবং দলিল লেখকদের একটি অংশ বলে একাধিক সূত্র জানায়। গত বৃহস্পতিবার ও রবিবার (১৩ জুলাই) বোয়ালমারী উপজেলার চতুল ইউনিয়ন ভূমি অফিস ঘুরে ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বললে তারা এসব অভিযোগ করেন। সম্প্রতি চতুল ভূমি অফিসের দায়িত্বে থাকা ভূমি কর্মকর্তা জহিরুল হকের বিরুদ্ধে এসব অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, একটি মিউটেশনের সরকারি চার্জ ১১৭০ টাকা। যা মোবাইল ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। একটি মিউটেশন বা নামজারীর জন্য ভূমি সেবার ওয়েব সাইটে প্রবেশ করে অনলাইনে কাগজপত্র সাবমিট করে আবেদন করতে হয়। আবেদন করার পর ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তার আইডিতে গিয়ে জমা হয়। পরবর্তীতে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে হার্ডকপি জমা দিতে হয়। এরপর ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর আইডিতে গিয়ে জমা হয়। তিনি যাচাই বাছাই শেষে অনুমোদন দিলে ১১০০ টাকা মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে পরিশোধ করে নামজারি বা মিউটেশন কপি সংগ্রহ করতে হয়। তবে আবেদনের সময় আবেদন ফি বাবদ ৭০ টাকা মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে কেটে নেওয়া হয়। সেখানে আবেদনকারী ৭০ টাকার ক্ষেত্রে ১০০ বা ২০০ টাকা নিতে পারেন। আবেদন যেকোন জায়গা থেকে করা যায়। চতুল ইউনিয়ন ভূমি অফিসটি উপজেলা সহকারী কমিশানরের (ভূমি) কার্যালয়ের উত্তর পাশে বোয়ালমারী পৌর বাজারের অবস্থিত। এই অফিসের চার পাশে রয়েছে সেলিম মুন্সি, পান্নু শেখ, জাহিদ ঠাকুর ও রবিউল ইসলামের কম্পিউটারের দোকান। ভূমি সেবা প্রত্যাশীরা বেশির ভাগ ভূমি সংশ্লিষ্ট অনলাইনে কাজ সম্পন্ন করে থাকেন এ সকল দোকান থেকে। যেখানে একটি মিউটেশনের সরকারি চার্জ ১১৭০ টাকা। অথচ সেবাগ্রহীতার কাজ থেকে নেওয়া হচ্ছে প্রকারভেদে ২ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
চতুল ভূমি অফিসের সামনে সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য আহসান হাবিব হাসান ও বাইখীর চৌরাস্তার মিলন শেখের কথা হলে তারা জানান, ভূমি অফিসের অতিরিক্ত অর্থ ছাড়া কোন ফাইল এসিল্যান্ড অফিসে যায় না। এ পর্যন্ত তাদের কোন মিউটেশন ৫-৬ হাজার টাকার কমে করতে পারেনি তারা। চতুল ইউনিয়নের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ভূমি কর্মকর্তা জহিরুল হক নিজের নিয়ন্ত্রণে কয়েকজন দালাল রেখে সেবা গ্রহীতাদের সাথে কথা বলান। কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি নিজেই অফিসের খরচের কথা বলে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেন। এহরামুজ্জামান নামে এক ব্যক্তির সাথে কথা হলে তিনি জানান, বাবা মারা গেছে বেশ কিছুদিন হল। বাবার নামে রেকর্ডীয় সম্পত্তি নামজারি করার জন্য গিয়েছিলাম চতুল ভূমি অফিসে। ওই অফিসে ৩-৪ কার্যদিবস যাওয়ার পর তহসিলদার সাহেব বললেন অফিস খরচ না দিলে কিভাবে ফরওয়ার্ডিং হবে। বাধ্য হয়ে ১ হাজার টাকা দিয়ে আমার কাজটা আমি করেছি। তারপরও খুশি আমার কাজতো হলো।
চতুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম এক প্রসঙ্গে বলেন, আমার ইউনিয়নের অনেকের কাছ থেকেই উনার (ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা) সম্পর্কে বিভিন্ন রকম কথা শুনেছি, তবে আমি নিজে কখনো সেখানে যায়নি। সৌদি প্রবাসী উপজেলার গুনবহা ইউনিয়নের চাপলডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা নাজমুল হোসেন বলেন, ভূমি অফিসে গিয়েছিলাম ৮ শতাংশ জমির নিউটেশন করতে। আমার কাছে সরকারি জমা টাকার বাইরে ১০ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে অফিস থেকে। তাহলে আমার কাজটি ৭দিনের মধ্যে তারা করে দিতে পারবেন বলে জানান। এ ব্যাপারে ফরিদপুরের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব মাসুদ রানা জানান, বতর্মান সরকার তৃণমুল পর্যায়ে মানুষের সেবা দেওয়ার জন্য নিরোলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তারপরেও এ কাজে যারা বাধা হয়ে দাঁড়াবে প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন গড়ে তুলবো।
ভূমি অফিসের হয়রানির বিষয়ে জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক গনমাধ্যম কর্মী হাসানউজ্জামান বলেন, গত জুলাই আন্দোলনে একটা পরিবর্তন হয়েছে। প্রশাসনের যে পর্যায় গুলোতে দুর্নীতির হওয়ার সম্ভাবনা বেশি সেখানে তদারকি হওয়া দরকার। সরকারের যেসব দপ্তরের দুর্নীতিবাজ লোক রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সকলের সোচ্চার হওয়া উচিত। ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজেশন হওয়ার পরেও মানুষের ভোগান্তি বা প্রতারনা মুক্ত কেন হয়নি প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) অ্যাড. গাজী শাহিদুজ্জামান লিটন বলেন, ভূমি সেবা ডিজিটালাইজেশন হলেও নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতেই রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানুষের সেবা দেওয়ার মন মানুষিকতা বাড়াতে হবে। সরকারি অফিসের উর্দ্ধত্মন কর্মকর্তারা তৃনমূলের অফিসগুলো ঠিকমত মনিটরিং করেন না বিধায় জনসাধারণরা ভোগান্তিতে পড়েন। চতুল ইউনিয়ন ভূমি অফিসে দায়িত্বরত কর্মকর্তা জহিরুল হককে বার বার ফোন দেওয়ার পর ৪র্থবার ফোনটি রিসিভ করে তিনি বলেন, চলতেছে। তার কাছে কি চলতেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যা বলেছি তাই। এখন আর কিছু বলতে চাচ্ছি না। এ ব্যাপারে বোয়ালমারী সহকারি কমিশনার ভূমি আব্দুল্লাহ আল আমিন বলেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় অনলাইন সার্ভিস চালু হওয়ার ফলে অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমেছে। তবে অনেকেই এই বিষয়টি ভালোভাবে না বুঝতে পারায় অন্য মারফর কাজ করতে গিয়ে হয়রানি বা দালালের খপ্পরে পড়ে। তখন তাদের অতিরিক্ত অর্থ নষ্ট হয়। আমরা সেবাপ্রত্যাশীদের বলবো, ভূমি সংশ্লিষ্ট কিছু বুঝতে বা করতে তৃতীয়পক্ষের কাছে না গিয়ে সরাসরি এসিল্যান্ড অফিসে আসুন। তিনি আরো বলেন, ভূমি অফিসের কারো বিরুদ্ধে সুনিদিষ্ট কোন অভিযোগ পেলে বিষয়টি যাছাই বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।