ভারপ্রাপ্ত আরএমও দিয়ে চলছে বোয়ালমারী হাসপাতাল
৩ মাস বেতন নেই ডাক্তারদের, চলেনা অ্যাম্বুলেন্স, আউট ডোরে টিকিটে নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা
তৈয়বুর রহমান কিশোর, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি : উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা না থাকায় বিশৃঙ্খলা ভাবে চলছে হাসপাতাল। ভারপ্রাপ্ত আরএমও দিয়ে চলছে হাসপাতাল।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ৩ মাস বেতন পাননা চিকিৎসকরা। ২ মাস বেতন পাননা কর্মচারীরা। চলে না অ্যাম্বুলেন্স। আউটডোর টিকিটে নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। এ অবস্থায় স্থবির হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাজকর্ম। দুর্ভোগে পড়েছে রোগীরা। আছে অবহেলায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ।
বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারী) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এম এম নাহিদ আল রাকিব বদলিজনিত কারণে গত ১৭ অক্টোবর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছেড়ে যান। স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দায়িত্ব পান তরুন চিকিৎসক আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. কে এম মাহমুদ রহমান। কিন্তু তাঁকে কতৃত্ব ছাড়া দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দায়িত্ব পেলেও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের দায়িত্ব পাননি তিনি। অপরদিকে কর্মরত চিকিৎসকদের অনেকের মধ্যেই তিনি (ডা. মাহমুদ) জুনিয়র। তাই সকলকে ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রন করতে পারেন না বা সিনিয়রদের অনেকের দায়িত্ব পালনে অবহেলা। এ কারণে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রায় কর্মকর্তারা ৩ মাস ও কর্মচারী গত ২ মাসের বেতন পায়নি। এ অবস্থায় অনেকেরই সংসার চলছেনা। তাই দায়িত্বেও অনেকের গা ছাড়া ভাব। সঠিকভাবে রোগীও দেখেন না চিকিৎসকরা। ডাক্তার না পেয়ে ফিরে যায় রোগী। অ্যাম্বুলেন্সের জ্বালানীর বাজেট থাকলেও অর্থ ছাড় না করায় চলছে না অ্যাম্বুলেন্স। এ জন্য রোগী এবং রোগীর স্বজনরা পড়েছেন বিপাকে। জরুরি রোগীরা ভাড়ায় চালিত অ্যাম্বুলেন্স বা মাইক্রো ভাড়া করে রোগী নিয়ে যাচ্ছেন ফরিদপুর বা ঢাকায়।
অপরদিকে চিকিৎসকের অবহেলায় আলিমের (দ্বাদশ) এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। বৃহস্পতিবার (১৯.১২.২৪) দুপুরে বোয়ালমারী পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের ছোলনা গ্রামের হাবিবুর রহমানের মেয়ে আলিম ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী কুলসুম (১৮) পেট ও মাথা ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে যায়। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মনিরুজ্জামান মনির তাকে ভালভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা না করে কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। বাড়ি নেওয়ার পর সে আরও অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। পুনরায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে অপর চিকিৎসক তাকে ফরিদপুর রেফার্ড করে। ফরিদপুর নেওয়ার আগেই কুলসুম মারা যায়। কুলসুমের পিতা হাবিবুর রহমান অভিযোগ করেন, ডাক্তার সঠিকভাবে না দেখে মুখের কথা শুনে ওষুধ লিখে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। বাড়িতে নেওয়ার পর মুখ দিয়ে ফেনা লালা বের হলে আবার তাকে হাসাপালে নেই। সেখানেই সে মারা যায়। তবে অবহেলার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ডাক্তার মনিরুজ্জামান মনির। তিনি বলেন, দুপুরে একটি অল্প বয়সী মেয়ে পেট ও মাথায় ব্যথা নিয়ে আসছিল। পরে চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়েছিলাম। আমি ভালভাবে তাকে দেখেছি। পেটে, মাথায় হাত দিয়ে দেখে বুঝে এবং তার কথা অনুযায়ী ওষুধ দিয়েছিলাম। তবে মেয়েটির অন্য কোন সমস্যা থাকতে পারে। একই দিন বিকেলে শ্বাসকষ্ট নিয়ে বেদেনা বেগম নামের আরেক রোগী যায় হাসপাতালে। জরুরি বিভাগে ডাক্তার না পেয়ে হাসপাতালের সামনে ভ্যানের উপর মারা যায় বেদেনা বেগম।
হাসপাতালে আসা অনেক রোগী মৌখিক অভিযোগ করে বলেন, আউট ডোরে টিকিট আনতে গেলে ৩ টাকার টিকিট ৫ টাকা করে নেয়। তবে ভারপ্রাপ্ত আরএমও ডা. মোরসেদ আলম অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, টিকিট ৩ টাকা করেই নেওয়া হয়। কারো কাছে টাকা ভাংটি না থাকলে হয় তো ৫ টাকা রাখে।
এদিকে ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কে এম মাহমুদ রহমান গত ৩১ জানুয়ারী ২ মাসের প্রশিক্ষনে ঢাকায় যান। আরএমওর ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পান ডা. মোরসেদ আলম। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত আরএমও হাসপাতাল চালাচ্ছেন। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দায়িত্বে কেউ নেই।
হাসপাতালের আউটডোরে টিকিট বিক্রির জন্য বসানো হয়েছে হাসপাতালে কর্মরত হারবাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (গাডেনার) শেখ মো. বদিরুজামান ও কম্পাউন্ডার মাহমুল হাসানকে। টিকিট বিক্রিতে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার বিষয়ে শেখ মো. বদিরুজামান বলেন, ৩ টাকা করে টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। অনেকে ৩ টাকা ভাংটি আনে না । তাই ৫ টাকা রাখতে হয়।
চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারী বলেন, হাসপাতাল তো আর হাসপাতাল নাই। ঠেলা গাড়ি হয়ে গেছে। ঠেলা ধাক্কা দিয়ে চালাতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা না থাকায় যে যেমন পারছে তেমন চলছে।
হাসপাতাল অফিস সূত্র থেকে জানা যায়, একশ সয্যার এ হাসপাতালে ব্যাপক জনবল সংকট রয়েছে। মোট ২১ জন ডাক্তারের পদ থাকলেও আছেন ১২জন। তার মধ্যে আবার তিন জন ডেপুটেশনে। বর্তমানে ৯জন মেডিকেল অফিসার ৩জন কনসালটেন্ট কাজ করছেন। দুইজন মেডিকেল অফিসার ও একজন কনসালটেন্ট ডেপুটেশনে অন্য যায়গায় কাজ করছেন। অপর একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন। দ্বিতীয় শ্রেণির নার্স ও সমপদের ৩৮জনের পদ থাকলেও বর্তমানে আছেন মাত্র ৩১জন। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর ৬৪ পদের বিপরিতে কাজ করছে মাত্র ২৮জন। চতুর্থ শ্রেণির ২৫জনের মধ্যে আছেন ১১জন। এতো এতো নাইয়ের মধ্যে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে নিয়মিত স্বাস্থ্য কর্মকর্তার না থাকা।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নাহিদ আল রাকিব চলে যাবার পর তিনজন ডাক্তারকে এ পদে বদলি করা হয়েছিল কিন্তু সেই তিনজনের কেউ যোগ দেননি। কেন তাঁরা যোগ দিলেন না সে বিষয়ে কোন সদউত্তর পাওয়া যায়নি।
এসব বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কে এম মাহমুদ রহমান বলেন, জনবলসহ অনেক সংকট রয়েছে। বিশেষ করে নিয়মিত উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা না থাকায় কিছু সমস্যা সৃষ্ট হয়েছে। বেতন না পেয়ে হাসপাতালের স্টাফরা দুর্ভোগে আছেন। ডাক্তাররা না হয় প্রাইভেট প্রাকটিস করেন কিন্তু কর্মকর্তা কর্মচারীরা ?
তিনজন ডাক্তারকে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে বদলী করা হলেও তাঁরা কেউ যোগদান করেননি। সংকটের মধ্যে আমি সাধ্যমতো সেবা দেওয়ার চেষ্ট করছি। নিজের পকেট থেকে খরচ করে কিছু কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। আর ডাক্তারের অবহেলায় মৃত্যু ও ডাক্তার না পাওয়ার বিষয়ে বলেন, আমাদেরকে কেউ লিখিতভাবে জানায়নি। লিখিত অভিযোগ পেলে অবস্যই খতিয়ে দেখা হবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হবে। তবে এমনটি ঘটে থাকলে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।
ভারপ্রাপ্ত আরএমও মোরসেদ আলম বলেন, হাসপাতাল চলাতে হিমশিম খাচ্ছি। যে ভাবে পারছি সে ভাবে চালাচ্ছি।