রাজশাহী ব্যুরো:
বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের এক নারী কর্মী কর্মস্থলে ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হলেও অভিযুক্তকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তা। ভুক্তভোগীর অভিযোগ, প্রথম দিন থেকেই তাকে ন্যায়বিচারের পরিবর্তে নানা হয়রানি ও অপমানের মুখে ফেলা হয়েছে।
ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালের ৭ মে। রাজশাহীর চীফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএমই) দপ্তরের ট্রেসার পদে কর্মরত ওই নারী অফিসে একা থাকাকালে সহকর্মী খালেক সিকদার তাকে জাপটে ধরে স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেন। ধস্তাধস্তির সময় আহত হন নারীটি। পরের দিন অর্থাৎ ৮ মে যন্ত্র প্রকৌশলী (সদর) ফজলে রব উভয়কে ডাকেন এবং সেখানেই খালেক নিজের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চান।
এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার বিচার না পেয়ে মামলা করতে গেলে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে ভুক্তভোগীকে। অবশেষে ২০ জুন ভুক্তভোগী ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় মামলা করেন (মামলা নং ১২৪/২৪ জিআর, নারী ও শিশু মামলা নং ২৬৬/২৪)। কিন্তু মামলার পরপরই শুরু হয় ক্ষমতার খেলা।
তবে এ ঘটনায় ৬ জুন রেলওয়ের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেখানে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয় ডেপুটি সিওপিএস হাসিনা খাতুনকে। যিনি দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত বিরোধ ও অভিযুক্তের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তদন্তে নিরপেক্ষ নন বলে অভিযোগ রয়েছে। তদন্তের নামে তিনি উল্টো ভুক্তভোগীকে মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করেন, অপমান করেন এবং ‘দোষারোপের’ পথ বেছে নেন। তদন্ত প্রতিবেদন ৭ কর্মদিবসে দেওয়ার কথা থাকলেও তা জমা দিতে সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে ৬ মাস। কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে নিজের মনগড়া প্রতিবেদন গত নভেম্বরের ৮ তারিখ শুক্রবার দাখিল করেন আহ্বায়ক হাসিনা খাতুন। এতে তিন সদস্যের মধ্যে একজন সাক্ষর না করায় প্রতিবেদনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এরপর ভুক্তভোগী নারী হাসিনা খাতুনের দেয়া সেই তদন্ত প্রতিবেদনটি তথ্য অধিকার আইনে কপি চাইলে রেল কর্তৃপক্ষ জানায়, “ঘটনা অমিমাংশিত” বলে প্রতিবেদন দেওয়া হবে না—যা স্বচ্ছতার প্রশ্ন তোলে।
অপরদিকে মানসিক চাপ ও অবিচারের বেদনায় ভুক্তভোগীর বাবা সাবেক রেল কর্মকর্তা আব্দুর রহমান ২৮ নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি মিডিয়ার কাছে হাসিনা খাতুনের আচরণ ও অবিচারের বর্ণনা ও আক্রসের কারন দিয়ে যান। যেখানে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীর ছোট ভাইকে বিয়ের জন্য বার বার প্রস্তাব দিয়েছিলেন হাসিনা খাতুন। সেই প্রস্তাবে নাকোচ করেছিলেন আজকের এই ভুক্তভোগী নারী। এটাই যেন ভুক্তভোগীর কাল হচ্ছে।
তবে রেলের এমন বৈষম্যের কারনে ভুক্তভোগী নারী বিচার প্রত্যাশী হয়ে রাজশাহী মহিলা সহায়তা কর্মসূচীর নিকট একটি অভিযোগ করেন। এরপর সেখানেকার সহকারী পরিচালক মাহবুবা সুলতানা সরেজমিন তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে ঘটনার সত্যতা পান। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “এই ঘটনায় হাসিনা খাতুনকে তদন্তে রাখা উচিত হয়নি। বাহ্যিক প্রভাবের চেষ্টা ছিল, যা আমি নিজ চোখে দেখেছি।”
অভিযোগ রয়েছে, শুধু হাসিনা খাতুনই নন—রেলওয়ের আরও কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তা অভিযুক্তকে রক্ষায় সক্রিয় রয়েছেন। কারণ এই ঘটনা প্রমাণিত হলে রেলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে, আর হাসিনার দেওয়া প্রতিবেদন মিথ্যা প্রমাণিত হবে। বর্তমানে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এ বিচারাধীন। আদালত প্রাথমিকভাবে অপরাধের পর্যাপ্ত উপাদান পেয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগেই প্রভাবশালী মহল অভিযুক্তকে নিরাপদ করিয়ে ফেলছে? ঘটনার কিছুদিন পর খালেক সিকদারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু বিচার ও তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ না হতেই তার বরখাস্ত তুলে নিয়ে অন্যত্র বদলী করা হয়েছে। রেল এমন কাজ করলো কিভাবে? কার ইন্ধন রয়েছে?
এদিকে রেল কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি আবারও একটি নতুন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। যা অত্যন্ত গোপনে। তবে সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, এই কমিটি আদৌও কি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে কাজ করবে? কারণ, ঘটনা প্রমাণিত হলে শুধু রেলের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ণ হবে না, বরং হাসিনা খাতুনের দেওয়া পূর্ববর্তী প্রতিবেদনও মিথ্যা প্রমাণিত হবে। ফলে হাসিনা ও তার প্রভাবশালী মহল যে কোনও মূল্যে সত্য প্রকাশ ঠেকাতে মরিয়া, এমনটায় আশঙ্কা অনেকের।
বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ফরিদ আহমেদ এর সাথে কথা বললে তিনি দৈনিক গণমুক্তিকে বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। তারপরও ঘটনা শোনার পর নতুন করে আবারও একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। আশাকরি তারা সত্য ও নিরপেক্ষ তদন্ত করবে। তদন্তে যদি উক্ত ঘটনার সত্যতা পায় তাহলে অবশ্যই অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
তারপরও প্রশ্ন তো থেকে যায়? যেখানে থানা পুলিশ ঘটনার সত্যতা পেয়ে চার্জশিট দিয়েছে, মহিলা সহায়তা কর্মসূচী ঘটনার সত্যতা পেয়েছে, ঘটনার পর্যাপ্ত তথ্য প্রমান পেয়ে চার্জ গঠন করেছে আদালত। তাহলে নতুন তদন্ত কমিটি কি নিরপেক্ষ ও সত্য প্রতিবেদন দিবেন?
এদিকে আইনের দীর্ঘ পথচলায় এই তরুণী যেন একা হয়ে না পড়েন, তার জন্য প্রয়োজন গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা এবং সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতা। কারণ ন্যায়বিচার শুধু একজন ভুক্তভোগীর অধিকার নয়, এটি পুরো সমাজের নিরাপত্তা ও ন্যায়ের পরীক্ষা।