হোসেনাবাদের সুধাসিন্ধু ভাব আশ্রমে ফকির শফি মণ্ডলের খেলাফত দিবস: ভক্তি, বাউলগান আর গ্রামের উৎসব
দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) থেকে মিজানুর রহমান রিপন:
নভেম্বরের নরম আলোয় ঢাকা হোসেনাবাদ স’মিলপাড়া গ্রামের আকাশে ভেসে আসে ঢোলের শব্দ, বাউলদের একতারা, আর দূরের কোনো তাঁবুর ভেতর থেকে ভেসে আসে গানের সুর—
“মন রে, তুই নিজের ঘর চিন্তে পারলি না…”
ফকির শফি মণ্ডলের সুধাসিন্ধু ভাব আশ্রমে এ যেন অন্য এক সময়ের গল্প। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শুরু হওয়া ২৪ ঘণ্টাব্যাপী খেলাফত দিবসের সাধুসঙ্গ এখন পরিণত হয়েছে ভক্তি, সংগীত আর লোকজ উৎসবে। গ্রামের প্রান্তরজুড়ে হাজারো মানুষের সমাবেশ, একদিকে সাধুসঙ্গের গাম্ভীর্য—অন্যদিকে মেলার আনন্দ।
ভক্তি ও ভাবের মিলনমেলা
আশ্রম প্রাঙ্গণে বসেছে সারারাতের গান ও সাধনার আসর। ভক্তরা কেউ বসেছেন মাটিতে, কেউ বা ছাউনি টাঙিয়ে গাইছেন গুরু লালন সাঁইয়ের বাণী। সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয়েছে ভক্তি সংগীত ও প্রার্থনা, আর বুধবার দুপুরে ‘পূর্ণসেবা’র মধ্য দিয়ে শেষ হবে এ আয়োজন।
ঢাকা থেকে আগত ভক্ত সাব্বির হোসেন বললেন,
“প্রতিবছরই খেলাফত দিবসে আমি আসি। গুরু শফি মণ্ডলের ভাবধারায় যে শান্তি পাই, তা আর কোথাও মেলে না। এখানে আসলে মনে হয়—মানুষ মানে একটাই, ভেতরের আলোক।”
মেলায় লোকজ রঙ
হোসেনাবাদ হিসনা নদীর তীরে আশ্রম ঘিরে বসেছে রঙিন গ্রামীণ মেলা। কোথাও কৃষিপণ্যের পসরা, কোথাও মাটির হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল, বাঁশের বাঁশি, কেউ আবার বিক্রি করছেন গরম চা, মুড়ি-মুড়কি বা গরুর দুধের দই। দোকানিরা জানালেন, তাঁরা দুই দিন আগেই দোকান সাজিয়ে বসেছেন, আর ক্রেতার ভিড় দেখে বেচাকেনায় খুশি সবাই।
এক বিক্রেতা হাসতে হাসতে বললেন,
“প্রতি বছরই এই সময়টা আমাদের জন্য আনন্দের। মানুষ আসে দূর-দূরান্ত থেকে, গান শোনে, খায়-দায়, আবার কিছু কিনে নিয়ে যায়। এ যেন গ্রামের ঈদ।”
সাধুসঙ্গের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা
বড় সমাগমের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দৌলতপুর থানা পুলিশও রয়েছে তৎপর। ওসি সোলাইমান শেখ জানান,
“মেলা এলাকা ও আশেপাশে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। যাতে সবাই নির্বিঘ্নে উৎসব উপভোগ করতে পারেন।”
গুরু ফকির শফি মণ্ডল: লালনের পথে এক জীবন
বাংলাদেশের বাউলসংগীত ও সুফি ধারার উজ্জ্বল নাম ফকির শফি মণ্ডল। ১৯৫২ সালের ১৩ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার ফিলিপনগরে জন্ম নেওয়া এই শিল্পী ছোটবেলা থেকেই গান ও ভাবধারায় আকৃষ্ট হন। ১৯৭৯ সালে ভারতে সাধন মুখার্জির কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নেওয়ার পর ফকির সুলতান শাহের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৯৫ সালে তাঁর প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয়, আর ১৯৯৮ সালের “লালনের দেশে” তাঁকে এনে দেয় দেশজুড়ে খ্যাতি। আজও তিনি তরুণদের বাউল সংগীত শিক্ষা দেন, লালন দর্শন প্রচার করেন, আর মানুষে মানুষে ভালোবাসার বাণী ছড়িয়ে দেন।
২০২২ সালের ১১ নভেম্বর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে খেলাফত গ্রহণ করেন। সেই দিনটিকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর আয়োজিত হয় এই সাধুসঙ্গ ও ভাব উৎসব।
আলো ও আধ্যাত্মিকতার এক রাত
রাত গভীর হলে একতারার ঝংকারে জেগে থাকে হোসেনাবাদ। দূরের কোনো তাঁবু থেকে শোনা যায় শিষ্যদের কণ্ঠ—
“গুরুরে না দেখলে, জীবন বৃথা যায়।”
চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে আশ্রম প্রাঙ্গণ। কেউ ভক্তিসঙ্গীত গাইছেন, কেউ নীরবে বসে ধ্যান করছেন। এ যেন শুধু এক উৎসব নয়—মানুষের ভেতরের আলো জ্বালানোর এক সাধনা।
ডেইলী নিউজ বাংলা ডেস্ক 




















