ঢাকা ০২:০৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম
দৈনিক দিনের খবর পত্রিকার ১৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন রাজশাহীর মোহনপুরে ওয়ার্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ফকিরপাড়া তরুণ সংঘ চ্যাম্পিয়ন বরেন্দ্র অঞ্চলে আমন ধানে ছত্রাক ও মাজরা পোকার আক্রমণে দিশেহারা কৃষকরা  লালপুরে চেয়ারম্যানের ছেলে সহ ইমো হ্যাক প্রতারক চক্রের ৩ সদস্য গ্রেপ্তার ঘোড়াঘাটে ফুটপাত ও ড্রেন দখল প্রশাসনিক অবহেলায় বাড়ছে ভোগান্তি ভোটের শক্তিতেই পরিবর্তন, বন্দুকের ভয় নয় — প্রফেসর ড. সাইফুল ইসলাম কুষ্টিয়ায় বিজিবির অভিযানে ১৮ লাখ টাকার  চোরাচালানী পণ্য জব্দ দৌলতপুরে জমি নিয়ে বিরোধে সৎভাইয়ের হাতে যুবক খুন, আহত ৩ মিরপুর মালিহাদে বিএনপি’র কর্মীসভা অনুষ্ঠিত জাতীয় পার্টি ব্যতীত নির্বাচন হবে না বাংলাদেশে — দৌলতপুরে আলোচনা সভায় শাহরিয়ার জামিল জুয়েল

গল্প: আলাল কানা – অন্ধ জীবনের বর্ণময় প্রদীপ- পর্ব ১

গল্প: আলাল কানা – অন্ধ জীবনের বর্ণময় প্রদীপ- পর্ব ১

রওশন জামাল জুয়েলঃ

সমাজ তাঁকে ডাকে “আলাল কানা” নামে। শব্দের মাঝে লুকিয়ে থাকে অশ্রদ্ধা, উপহাস, কখনোবা নির্মম বিদ্রুপ। কিন্তু এই সমাজ জানে না, যে চোখ নেই – সেই মানুষটিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন কেমন হওয়া উচিত এক সত্যিকার আলোকিত জীবন।

তাঁর নাম জহুরুল ইসলাম আলাল। জন্ম চরাঞ্চলের এক দরিদ্র পরিবারে। তিন বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিরতরে হারিয়ে ফেলেন চোখের দৃষ্টিশক্তি। তখনও তাঁর জানা ছিল না সবুজ গাছের ছায়া কেমন, নদীর ঢেউ কেমন শব্দ করে, কিংবা মায়ের মুখে কেমন মায়া লুকিয়ে থাকে।

তাঁর স্মৃতিতে নেই স্নিগ্ধ কোনো বিকেল, আকাশের রং বদলের খেলা, কিংবা কুয়াশাভেজা সকালের কোমলতা। নেই বৃষ্টির পরে ভিজে পৃথিবীর ঘ্রাণ দেখা—যা আমরা চোখে দেখি, আর তিনি অনুভব করেন হৃদয়ে। তবুও তিনি হেরে যাননি। তাঁর চারপাশের সমাজ যখন তাঁকে শুধু করুণা আর অবহেলার চোখে দেখেছে, তিনি তখন মনে মনে গড়েছেন নিজের রাজ্য। সে রাজ্যে প্রবেশের চাবিকাঠি ছিল—জ্ঞানের আলো, ঈমানের গভীরতা আর স্বপ্ন দেখার সাহস।

তিনি ইংরেজি ও আরবি ভাষায় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন, সাথে বাংলা, উর্দু ও ফারসি ভাষায় পান অসাধারণ দখল। পাঁচটি ভাষার পণ্ডিত এই মানুষটি হয়তো চোখে আলো দেখেন না, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে ছিল নূরের দিশা।

দেখা যায় না বলে হয়তো সমাজ তাঁকে “অচল” ভেবেছে, কিন্তু তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কত শত ছেলেমেয়েকে। হয়তো তিনি সেলফিতে ধরা পড়েন না, কিন্তু তাঁর ছাত্ররা আজ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাঁর হাঁটার পথটা হয়তো অস্পষ্ট ছিল, কিন্তু তাঁর জীবনদর্শন ছিল অকাট্য, দৃঢ় ও উজ্জ্বল। অন্ধজীবনে তিনি কখনো হায় হায় করেননি।
তিনি বলেন, “দৃষ্টিশক্তি না থাকাটা আমার জন্য পরীক্ষা, কিন্তু মস্তিষ্ক, হৃদয় আর আত্মা তো আল্লাহ দিয়েছেন—ওগুলো দিয়ে পৃথিবীকে চিনেছি।”

এই সমাজ হয়তো তাঁকে সম্মান দিতে ভুলে গেছে, সম্মোধনে রেখেছে “কানা” শব্দের বিষাক্ত দংশন। কিন্তু চরাঞ্চলের বাতাস জানে—জহুরুল ইসলাম আলাল ছিলেন এক জীবন্ত মশাল।

তিনি জীবনকে জিতেছেন সাহস দিয়ে। তিনি হেঁটেছেন আলোর পথে, যদিও তাঁর চোখে কখনো আলো ছিল না।
তাঁর জীবনপ্রবাহে ছিল না চোখে দেখা রঙিন পৃথিবী, কিন্তু ছিল বর্ণময় চিন্তার অসীম ক্যানভাস।

আজ যখন আমরা স্মার্টফোনের আলোয় অন্ধ হয়ে যাচ্ছি, তখন আলাল ভাইয়ের মতো মানুষরা সত্যিকারের আলোয় চলছেন। যে আলো আসে কোরআনের তাফসীর থেকে, হাদীসের মর্মবাণী থেকে, আর মায়ের হাতে মুখে শেখা সাহস থেকে।

সমাজ তাঁকে ‘কানা’ বলেছে, ইতিহাস একদিন তাঁকে বলবে—প্রবাহমান এক দৃষ্টিশক্তিহীন দীপ্তিমান মানব।

শেষকথা:
আলাল ভাই চোখে না দেখেও দেখতে শিখিয়েছেন, বঞ্চিত হয়েও দিতে শিখিয়েছেন, অন্ধ হয়েও আলোকিত করেছেন।
এই গল্পটা তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, এবং সমাজের প্রতি এক জবাব।

Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ

দৈনিক দিনের খবর পত্রিকার ১৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

গল্প: আলাল কানা – অন্ধ জীবনের বর্ণময় প্রদীপ- পর্ব ১

আপডেট টাইম : ১১:০০:৪১ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫

গল্প: আলাল কানা – অন্ধ জীবনের বর্ণময় প্রদীপ- পর্ব ১

রওশন জামাল জুয়েলঃ

সমাজ তাঁকে ডাকে “আলাল কানা” নামে। শব্দের মাঝে লুকিয়ে থাকে অশ্রদ্ধা, উপহাস, কখনোবা নির্মম বিদ্রুপ। কিন্তু এই সমাজ জানে না, যে চোখ নেই – সেই মানুষটিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন কেমন হওয়া উচিত এক সত্যিকার আলোকিত জীবন।

তাঁর নাম জহুরুল ইসলাম আলাল। জন্ম চরাঞ্চলের এক দরিদ্র পরিবারে। তিন বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিরতরে হারিয়ে ফেলেন চোখের দৃষ্টিশক্তি। তখনও তাঁর জানা ছিল না সবুজ গাছের ছায়া কেমন, নদীর ঢেউ কেমন শব্দ করে, কিংবা মায়ের মুখে কেমন মায়া লুকিয়ে থাকে।

তাঁর স্মৃতিতে নেই স্নিগ্ধ কোনো বিকেল, আকাশের রং বদলের খেলা, কিংবা কুয়াশাভেজা সকালের কোমলতা। নেই বৃষ্টির পরে ভিজে পৃথিবীর ঘ্রাণ দেখা—যা আমরা চোখে দেখি, আর তিনি অনুভব করেন হৃদয়ে। তবুও তিনি হেরে যাননি। তাঁর চারপাশের সমাজ যখন তাঁকে শুধু করুণা আর অবহেলার চোখে দেখেছে, তিনি তখন মনে মনে গড়েছেন নিজের রাজ্য। সে রাজ্যে প্রবেশের চাবিকাঠি ছিল—জ্ঞানের আলো, ঈমানের গভীরতা আর স্বপ্ন দেখার সাহস।

তিনি ইংরেজি ও আরবি ভাষায় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন, সাথে বাংলা, উর্দু ও ফারসি ভাষায় পান অসাধারণ দখল। পাঁচটি ভাষার পণ্ডিত এই মানুষটি হয়তো চোখে আলো দেখেন না, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে ছিল নূরের দিশা।

দেখা যায় না বলে হয়তো সমাজ তাঁকে “অচল” ভেবেছে, কিন্তু তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কত শত ছেলেমেয়েকে। হয়তো তিনি সেলফিতে ধরা পড়েন না, কিন্তু তাঁর ছাত্ররা আজ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাঁর হাঁটার পথটা হয়তো অস্পষ্ট ছিল, কিন্তু তাঁর জীবনদর্শন ছিল অকাট্য, দৃঢ় ও উজ্জ্বল। অন্ধজীবনে তিনি কখনো হায় হায় করেননি।
তিনি বলেন, “দৃষ্টিশক্তি না থাকাটা আমার জন্য পরীক্ষা, কিন্তু মস্তিষ্ক, হৃদয় আর আত্মা তো আল্লাহ দিয়েছেন—ওগুলো দিয়ে পৃথিবীকে চিনেছি।”

এই সমাজ হয়তো তাঁকে সম্মান দিতে ভুলে গেছে, সম্মোধনে রেখেছে “কানা” শব্দের বিষাক্ত দংশন। কিন্তু চরাঞ্চলের বাতাস জানে—জহুরুল ইসলাম আলাল ছিলেন এক জীবন্ত মশাল।

তিনি জীবনকে জিতেছেন সাহস দিয়ে। তিনি হেঁটেছেন আলোর পথে, যদিও তাঁর চোখে কখনো আলো ছিল না।
তাঁর জীবনপ্রবাহে ছিল না চোখে দেখা রঙিন পৃথিবী, কিন্তু ছিল বর্ণময় চিন্তার অসীম ক্যানভাস।

আজ যখন আমরা স্মার্টফোনের আলোয় অন্ধ হয়ে যাচ্ছি, তখন আলাল ভাইয়ের মতো মানুষরা সত্যিকারের আলোয় চলছেন। যে আলো আসে কোরআনের তাফসীর থেকে, হাদীসের মর্মবাণী থেকে, আর মায়ের হাতে মুখে শেখা সাহস থেকে।

সমাজ তাঁকে ‘কানা’ বলেছে, ইতিহাস একদিন তাঁকে বলবে—প্রবাহমান এক দৃষ্টিশক্তিহীন দীপ্তিমান মানব।

শেষকথা:
আলাল ভাই চোখে না দেখেও দেখতে শিখিয়েছেন, বঞ্চিত হয়েও দিতে শিখিয়েছেন, অন্ধ হয়েও আলোকিত করেছেন।
এই গল্পটা তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, এবং সমাজের প্রতি এক জবাব।