রাজশাহীতে “সেইফ হেলথ্ কেয়ার” ২২০ টাকার কার্ড বানিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা
:- পর্ব ১
রাজশাহী প্রতিবেদক: বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা এরই মধ্যে রাতারাতি কোটিপতি হবার স্বপ্ন দেখিয়ে সম্প্রতি কিপ্টোকারেনসি এমটিএফই ৮ লাখ গ্রাহকেকে নিঃস্ব করে নিয়ে গেছে সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকা। এঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকসহ টনক নড়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। এরপরেও থামছেনা প্রতারণা ও দূর্নিতি। নানা সময়ে, নানা উপায়ে, নানান প্রলোভনে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার লোভ দেখিয়ে প্রতারকরা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। কিছু কিছু চক্রের টার্গেট মুলত গরীব অসহায় সুবিধা বঞ্চিত অসহায় মানুষ। প্রতিটি কাজ দেখভাল করার জন্য সরকারি সংস্থার লোকবল থাকলেও মুলত বড় ধরনের স্ক্যাম না হওয়া পর্যন্ত তা দমন করতে যেন কোন দায় নেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের। যখন কোন প্রতারক চক্র কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করে পালিয়ে যায় মুলত তখনই এসব সংস্থাগুলি নড়ে চড়ে বসে। ততক্ষণে পগার পার জালিয়াত চক্র।
রাজশাহী সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় গরীব মারা এ রকমই এক ফাঁদ পেতে বসেছে “সেইফ হেলথ্ কেয়ার” নামে একটি নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। এটি রাজশাহী নগরীর সিএনবি মোড়ের এক ঠিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন ডাঃ উম্মে সালমা। যিনি নানান অভিযোগে অভিযুক্ত। রয়েছে একের অধিক অভিযোগ।
সেইফ হেলথ্ কেয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ উম্মে সালমা স্বাক্ষরিত প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসক, উপজেলা পরিষদ, ইউএনও, ওসি, ইউনিয়ন পরিষদ বরাবর লিখিত আবেদন করেই রাজশাহী নগরীসহ চারঘাট, মোহনপুর, পবাসহ বিভিন্ন উপজেলায় তেরটি শাখা খুলে তা পরিচালনার জন্য টাকার বিনিময়ে ৫৪ জন অফিস কর্মকর্তা কর্মচারী ছাড়াও ডিলার নিয়োগ দিয়ে ইতোমধ্যেই হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিভিন্ন অফিসে আবেদন করে কোন প্রশাসনিক অনুমতি ছাড়াই চলছে তাদের কার্যক্রম।
জানাগেছে, সেইফ হেলথ্ কেয়ার রাজশাহী নগরীসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অসহায় গরিব দুঃখী ও মধ্যবিত্ত মানুষের টার্গেট করে তাদের মাঝে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান,পুষ্টি বিষয়ক কার্যক্রম,স্বল্পমূল্যে ভোগ্যপণ্য বিতরণ ও কর্মসংস্থান তৈরি করবে বলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এই কার্যক্রমের সুবিধা পেতে হলে একজন গ্রাহককে ২২০ টাকা দিয়ে একটি রেজিষ্ট্রেশন কার্ড করতে হবে যা অফেরতযোগ্য। সেইফ হেলথ কেয়ার এর এরকম কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি না থাকলেও পিজেকেইউএস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র ব্যবহার করে ঢাকঢোল পিটিয়ে অফিস উদ্বোধন করা হয়েছে এবং তা চলছে স্থানীয় সরকারের লোকজনের মাধ্যমে।
সেইফ হেলথ কেয়ার নামে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ উম্মে সালমা ” পায়রাবন্দ জনকল্যাণ উন্নয়ন সংস্থা” (পিজেকেইউএস) নামে একটি সংস্থার কাগজপত্র সংগ্রহ করে সেই প্রতিষ্ঠানের কাউকে না জানিয়ে কোন চুক্তি সম্পাদনা ছাড়াই সংস্থার গভঃ রেজিঃ নং- ৫৮৯/৯৯, জয়েন্ট স্টক কোম্পানির রেজিঃ নং- এস-১২৯৯১/২০১৮, এনজিও এফেয়ার্স বুরো রেজিঃ নং- ৩২৬৮-০৯/০৩/২০২১ লাইসেন্স ব্যবহার করে উক্ত সংস্থার ভুয়া প্রকল্প পরিচালক (স্বাস্থ্য) পরিচয়ে রাজশাহী নগরীসহ বিভিন্ন উপজেলায় তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
সেইফ হেলথ্ কেয়ার দুস্থ, অসহায়, গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষকে বয়স্ক, শিশুভাতা সহ বিভিন্ন ভাতা ও সুযোগ সুবিধা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে
একটি পরিবারের জন্য রেজিঃ ফি দুইশত কুড়ি টাকা, ভিজিট ফি একশ টাকা, প্রতিবছরে কার্ড নবায়ন ফি একশ টাকা এছাড়াও কার্ডধারীদের মাঝে নিম্নমানের এলটিএস ভোগ্যপণ্য চাউল,আটা,সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, ডাল,চিনি বিতরণ করছেন যার সর্বচ্চো আনুমানিক মূল্য চার’শ পঞ্চাশ টাকা হবে অথচ আদায় করছেন ছয়’শ পঞ্চাশ টাকা।
সেইফ হেলথ কেয়ার এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও বর্তমান রাজনৈতিক দলের পদধারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। মুলত তাদের মাধ্যমেই জনগণকে কার্ড করে দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। কৌশল হিসেবে তারা প্রতি সপ্তাহে টিসিবি’র মতো করে এলটিএস নামে নিম্নমানের ভোগ্যপন্য বিক্রয় করছেন। সপ্তাহে একদিন কার্ডধারী পরিবারের সদস্যদের শাখা অফিসে ডেকে নিয়ে ডিপ্লোমা পাশ লোককে এমবিবিএস ডাঃ পরিচয় করিয়ে লিখাচ্ছেন ব্যবস্থাপত্র। রোগীদের বিভিন্ন মারাত্মক অসুখের কথা বলে শারিরীক পরীক্ষা নীরিক্ষার জন্য তাকে যেতে হচ্ছে নগরীর সিএন্ডবি মোড়ে অবস্থিত সেইফ হেলথ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। যেখানে বিভিন্ন রোগ নির্নয় করতে পরীক্ষা নীরিক্ষার নামে আদায় করা হচ্ছে দ্বিগুণ টাকা।
মোহনপুর উপজেলা সেইফ হেলথ কেয়ার পরিচালিত শাখা অফিসে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পায়রাবন্দ জনকল্যাণ উন্নয়ন সংস্থার ব্যানার টানিয়ে অফিসে কাজ করছেন দুই ইউপি সদস্য ও অফিসের লোকজন। এখানে লোকজনের ভোটার আইডি ছবি ও টাকা জমা দিতে আসছেন অন্যান্য ইউপি সদস্যরা।
অফিসের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে তারা সরকারি কোন প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এসময় কার্যক্রম চালানোর অনুমতি সংক্রান্ত কাগজপত্র আছে কিনা? প্রতিবেদক জানতে চাইলে বাকশিমইল ইউপি সদস্য শাহাবুল জানান, আমি এ অফিসে চাকরি করি। অফিসের ডিলার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সানজিদা রহমান রিক্তা আপা তাকে ফোন দেন তিনিই এ অফিসের সব কিছু।
এবিষয়ে কাগজ পত্র আছে কিনা জানতে চাইলে মোহনপুর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সানজিদা রহমান রিক্তা বলেন, আপনি অন্যদিন আসেন আমি আপনাকে কাজগপত্র দেখাবো। পরে তিনি কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।
এব্যাপারে মোহনপুর শাখা অফিসের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যানেজার শিরিনা আক্তার মোবাইল ফোনে জানান, বর্তমানে এ অফিসে ২২০ টাকা করে কার্ডধারীর সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে। প্রতিদিনই সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। তার তথ্যমতে পাঁচ হাজার কার্ডধারী হলে ২২০ টাকা করে মোট এগার লাখ টাকা শুধু রেজিষ্ট্রেশন করেই এক শাখায় আদায় করা হয়েছে। তাহলে তেরটি শাখায় কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে এবং তা চলমান রয়েছেন পাঠকের বুঝতে কোন সমস্যা না হবারই কথা।
বলা দোষের কি? এটাতো শুধু রেজিষ্ট্রেশন বাবদ আদায় গোপন সংবাদে জানাগেছে এলটিএস নামে যে ভোগ্যপন্য দেওয়া হচ্ছে প্রতিটি সদস্য থেকে সংস্থার লাভ হচ্ছে ১৪০/১৫০ টাকা। সচেতন মহলের ধারনা তারা বিভিন্ন ভাতা দেওয়ার নামে প্রকাশ্যে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। যা ভবিষ্যতে মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের সম্মান হানির বিষয় হতে পারে। স্থানীয় প্রশাসনের উচিত এই সংস্থা সম্পর্কে ভালভাবে খোঁজ নেওয়া তারা আদৌও এধরনের কার্যক্রম জনগণের মাঝে চালাতে পারবে কি না?
এবিষয়ে সেইফ হেলথ কেয়ার পরিচালক
ডাঃ উম্মে সালমার কাছে জানতে চাইলে তিনি তার সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। অন্যের লাইসেন্স ব্যবহার করে সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এটা কি অপরাধ না এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান এবং এ প্রতিবেদককে তার অফিসে দেখা করতে বলেন।
তবে গোপন সংবাদে জানা গেছে, সংস্থাটি ২২০ টাকার বিনিময়ে ৫০ হাজার গ্রাহককে কার্ড করে দেওয়ার টার্গেট নিয়ে মাঠে কাজ করছে। যেখান থেকে শুধু কার্ড তৈরী করেই সংস্থার আয় হবে ১কোটি দশ লাখ টাকা। পন্য বিক্রি করে আয় করবে ৭০ লাখ টাকা। ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যে রোগীরা শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে আসবে সেখান থেকে ধরা হয়েছে ১কোটি টাকা। আর বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি অফিসে কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে আয়ের টার্গেট আরো এক কোটি টাকা।
এবিষয়ে পায়রাবন্দ জনকল্যাণ উন্নয়ন সংস্থার সহ-সভাপতি মোঃ হাসান রাজা বলেন, আমাদের অনুমতি ছাড়া রাজশাহীতে ডাঃ উম্মে সালমা নামে একজন ভুয়া প্রকল্প পরিচালক পরিচয়ে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার নামে টাকা পয়সা উত্তোলন করছেন এমন একটি অভিযোগ পেয়েছি। পায়রাবন্দ জনকল্যাণ উন্নয়ন সংস্থা কোন প্রকল্প পরিচালনার জন্য কারো সাথে কোন ধরনের চুক্তি সম্পাদন করেনি। যদি কেউ আমাদের সংস্থার নাম ভাঙ্গিয়ে অর্থনৈতিক কোন লেনদেন কার্যক্রম পরিচালনা করেন তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে।
এ বিষয়ে চারঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সোহরাব হোসেন বলেন, চারঘাটে সেইফ হেলথ কেয়ার নামে একটি এনজিও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে কাজ শুরু করেছিল। আমি তাদের কার্যক্রম পরিচালনার কাগজ দেখতে চাইলে তারা দেখাতে পারেনি। একারণে জনপ্রতিনিধিদের ওই এনজিও’র সাথে কাজ করতে নিষেধ করেছি। গত মাসে জেলা প্রশাসক স্যারের আইনশৃঙ্খলা সভায় সেইফ হেলথ কেয়ার এর কার্যক্রম বন্ধ আলোচনা করা হয়েছে। এরপরেও তারা কার্যক্রম পরিচালনা করলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহম্মেদ এর সরকারি নাম্বারে একাধিকবার চেষ্টা করে বক্তব্য পাওয়া সম্বব হয়নি।
আগামী পর্বে সেইফ হেলথ কেয়ার পরিচালক কথিত নারী চিকিৎসক উম্মে সালমা খাতুন কার কার থেকে নিয়োগ বাবদ টাকা নিয়েছেন ডিডিওসহ আসছে বিস্তারিত।