জিল্লুর রহমান, কম্বোডিয়া: কম্বোডিয়া, যার দাফতরিক নাম কাম্পুচিয়া রাজ্য, হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোচীন উপদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত একটি দেশ। এর আয়তন ১,৮১,০৩৫ বর্গকিলোমিটার (৬৯,৮৯৮ বর্গমাইল) এবং দেশটির উত্তর-পশ্চিমে থাইল্যান্ড, উত্তরে লাওস, পূর্বে ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে থাইল্যান্ড উপসাগর অবস্থিত।
কম্বোডিয়ায় দুই ঋতুসম্পন্ন একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মৌসুমী জলবায়ু রয়েছে এবং দেশটি টোনলে সাপ হ্রদ ও মেকং বদ্বীপের চারপাশে একটি কেন্দ্রীয় প্লাবনভূমি নিয়ে গঠিত, যা পাহাড়ি অঞ্চল দ্বারা বেষ্টিত। দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর নম পেন।
সার্বভৌম কম্বোডিয়া রাষ্ট্রের জনসংখ্যা ১৭ মিলিয়নেরও বেশি। সংবিধানে বৌদ্ধধর্মকে দাফতরিক রাষ্ট্রধধর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশেরও বেশি।
কম্বোডিয়ার সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভিয়েতনামি, চীনা, চাম ও ৩০টি পাহাড়ি উপজাতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, এর মধ্যে (৯৭.১% বৌদ্ধধর্ম (রাষ্ট্রধর্ম) ২.০% ইসলাম ০.৩% খ্রিস্টধর্ম ০.৫% অন্যান্য। রাজধানী ও বৃহত্তম শহর নমপেন হল কম্বোডিয়ার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
রাজ্যটি হল একটি নির্বাচনী সাংবিধানিক রাজতন্ত্র যার একজন সম্রাট, বর্তমানে নরোদম শিহামনি, সিংহাসনের রাজকীয় পরিষদ কর্তৃক রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে নির্বাচিত হন। সরকারপ্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী, বর্তমানে হুন সেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘকালীন অরাজকীয় নেতা, যিনি ১৯৮৫ সাল থেকে শাসন করেছেন।
প্রাচীনকাল থেকেই কম্বোডিয়াতে রাজতন্ত্র বিদ্যমান ছিল। এক হাজার বছরেরও আগে কম্বোডিয়া খমের জাতির আংকর সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল। আংকর সাম্রাজ্যটি ৬০০ বছর ধরে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে বিস্তৃত ছিল। ১৮৬৩ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এটি একটি ফরাসি প্রোটেক্টোরেট ছিল। ১৯৭০ সালে রাজতন্ত্রের স্থানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ১৯৭৫ সালে খমের রুজ নামের একটি সাম্যবাদী সরকার ক্ষমতা লাভ করে।
তারা দেশটিকে গণতন্ত্রী কাম্পুচিয়া নাম দেয়। খমের রুজের নিপীড়ন এবং চরমপন্থী সমাজতান্ত্রিক সংস্কার কম্বোডিয়ার সমাজ ও অর্থনীতিতে ধ্স নামায়। ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার খমের রুজ-বিরোধী শক্তি সরকারটির পতন ঘটায় এবং অপেক্ষাকৃত সহিষ্ণু একটি সাম্যবাদী সরকার গঠন কর। ১৯৮৯ সালে দেশটি সমাজতন্ত্র পরিত্যাগ করে এবং ১৯৯৩ সালে একটি নতুন সংবিধান পাস করে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।
পৃথিবীতে সবচাইতে বড় বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরটি (এঙ্কর ওয়াট) কম্বোডিয়ায় অবস্থিত। এঞ্জেলিনা জোলি অভিনীত টম রাইড়ার ছবিটির শুটিং হয়েছিল কম্বোডিয়ার এঙ্কর ওয়াটে।
আমাদের ১৯৭১ সালের মতো তাদেরও রয়েছে বিভীষিকাময় অধ্যায় (খামার রুজ শাসনামল জেনোসাইড)।
এতকিছুর পরেও কম্বোডিয়া আজ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কম্বোডিয়াতে স্থাপিত হচ্ছে বিশ্বের নবম বৃহত্তম বিমানবন্দর।
কম্বোডিয়ার রাজধানীর নাম নম পেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর হচ্ছে সিয়ানুকভিল। ক্যাসিনোর সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো শহর। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এই সিয়ানুকভিল হতে যাচ্ছে আরেকটি ইকোনমিক জোন। চীনা বিনিয়োগের সহায়তায় এ শহরটি হতে যাচ্ছে এশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর পরিকল্পিত শহরগুলোর একটি। এখানে গড়ে উঠেছে বড় বড় শপিং মল, ফাইভ স্টার হোটেল। সমুদ্রের পাশে অবস্থিত শহরটিতে রয়েছে ছবির মতো সুন্দর সৈকত।
কোভিডের থাবায় যখন পুরো বিশ্ব থেমে ছিল তখনো কম্বোডিয়া তার গতি বজায় রেখেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় কম্বোডিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা। চীনা বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি ও ফরাসি, জাপানি, কোরিয়ানসহ বহু দেশের বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগ করছেন।
রিয়াল এস্টেট, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, কৃষি, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, আইটি, ফার্মাসিউটিক্যালসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছেন। এর ফলে এখানে তৈরি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান। আমাদের দেশের বেকার যুব সমাজের জন্য এ কম্বোডিয়া হতে পারে পরবর্তী গন্তব্য।
কম্বোডিয়াতে ইউএস ডলার ব্যবহৃত হয়। জাতিগতভাবে কম্বোডিয়ানরা আমাদের দেশের মানুষের মতো সহজ-সরল।
কম্বোডিয়া আসিয়ানভুক্ত দেশ হওয়ায় আসিয়ানভুক্ত অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা করার জন্য কোনো প্রকার শুল্ক প্রদান করতে হয় না।
কম্বোডিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হুন মানেতকে নির্বাচিত করেছে দেশটির পার্লামেন্ট। দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের বড় ছেলে তিনি। ২০২৩ সালের গত জুলাই মাসে প্রধান বিরোধী দল ছাড়াই কম্বোডিয়ায় একতরফা নির্বাচন হয়। এতে জয়ী হয় হুন সেনের কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি (পিপিপি)।
নির্বাচনের এক মাস পর কম্বোডিয়ার পার্লামেন্ট সদস্যদের সর্বসম্মত ভোটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন হুন মানেত। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করেন পার্লামেন্ট সদস্য হেন সামরিন। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর পার্লামেন্ট সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণ দেন নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত। তিনি বলেন, ‘কম্বোডিয়ার ইতিহাসে আজ ঐতিহাসিক একটি দিন।
প্রায় চার দশক ধরে কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন হুন সেন। গত মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর তিনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। বড় ছেলে হুন মানেতকে ক্ষমতায় বসানোর কথা জানিয়েছিলেন তখন।
হুন মানেত বলেন, অর্থনীতি চাঙা করার ওপর গুরুত্ব দেবে তাঁর সরকার। এ ছাড়া মানুষের জীবিকা বাড়ানো, সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে দেশকে প্রতিষ্ঠা করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কীভাবে খাওয়ানো যায়, সেটির ওপরও জোর দেওয়া হবে।
নবগঠিত সরকারের মন্ত্রিসভার একটি খসড়া তালিকা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, শীর্ষ পদগুলোতে হুন মানেতের আত্মীয়স্বজন ও হুন সেনের সহযোগীদের সন্তানদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। হুন সেনের কনিষ্ঠ ছেলে হুন মানেকে সিভিল সার্ভিস মন্ত্রী করা হতে পারে। অপর দিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভাতিজা ও বর্তমান পুলিশপ্রধান নেথ সেভুইনকে দেওয়া হতে পারে উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব। বর্তমান স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন তাঁদের দুই ছেলে।