ঢাকা ১১:৫৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম
রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান:  অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন হোসেনাবাদ টেকনিক্যালে একাদশ শ্রেণিতে সবাই অকৃতকার্য বোয়ালমারীতে সদ্য ঘোষিত বিএনপির কমিটি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, টায়ারে আগুন বোয়ালমারীতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি, স্বর্ণলঙ্কারসহ কোটি টাকার মালামাল লুট  দৌলতপুরে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে কৃষি প্রণোদনা বিতরণ ২০ বছর পর রায়: খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দুইজনকে হত্যায় ৪ জনের যাবজ্জীবন পুলিশের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত  প্রশিক্ষণ কোর্স এর উদ্বোধন করলেন এসপি সাফিউল সারোয়ার দিনাজপুরের কৃতি সন্তান রোকমুনুর জামান রনি আবারও বেসিস সহায়ক কমিটিতে নির্বাচিত পদ্মার চরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ৩, গুলিবিদ্ধ ২ যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে তার পক্ষে কাজ করতে হবে, তারেক রহমান

অদৃষ্টের হাসি

অদৃষ্টের হাসি

তপু রায়হান—নামটা শুনলেই মনে হয় কোনো নায়কের গল্প শুরু হবে। লম্বা-চওড়া, ছিপছিপে গড়ন, পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির দীর্ঘদেহ, চোখ দুটো যেন কালো জলের ফোয়ারা। প্রথম দেখায় যে কোনো নারীর চোখ আটকে যেত তার দিকে। কিন্তু এখন? বয়স পঞ্চাশ, চুলে পাক ধরা, চোখের নিচে কালি, আর জীবনের সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার।

কৈশোরে নিরবে প্রেম এসেছিল একদিন। মেয়েটা প্রায়ই তাকে দেখে হাসত। তপু লাজুক স্বভাবে জিজ্ঞেস করত, “কেমন আছো তুমি? তোমার হাসিতে মনে হয়, প্রেম না দিলেও চলবে—শুধু হাসিই যথেষ্ট।” মেয়েটি মিষ্টি সুরে বলত, “ঘিন্না লাগে!” তপু হেসে উত্তর দিত, “এতদিন ধরে তোমার হাসি দেখছি, কিন্তু আমার ঘেন্না তো শেষ হয় না। আমি আর কতকাল ঘেন্নার পাত্র হয়ে থাকব?” ওই হাসিই ছিল তার প্রথম অঙ্কুরিত ভালোবাসা—যা কখনো ফুল হয়ে ফুটতে পায়নি।

তপুর জীবনে এসেছে অনেক মেয়ে। সবাই বলেছে, “তুমি খুব ভালো মানুষ!” কিন্তু কেউ বলে নি, “তুমি খুব ভালো প্রেমিক!” প্রথম প্রেমিকা তাকে শুধু বন্ধু ভাবত, প্রেমিক নয়। তবুও তপু প্রথাগত ভালোবাসায় ডুবে ছিল, আর সেই বিরহে বেছে নিয়েছিল নিঃসঙ্গতা। এভাবেই তার সাথে বন্ধুত্বের ছাড়াছাড়ি হয়। এই বিচ্ছেদেই তাকে নেশার জগতে টেনে আনে। এরপরও আরেকজনকে ভালোবাসত, কিন্তু বিয়ে করল অন্যকে। কারণ, হিসাবে মেয়েটি বলল”তুমি খুব ইমোশনাল, সংসারের ভার নিতে পারবে না!” শেষে বিয়ে করেছিলেন সুন্দরী এক মেয়েকে। কিন্তু তিন বছর পরেই সে চলে গেল। বলেছিল, *”তুমি শুধু গান শুনে আর কবিতা লিখে সময় কাটাও। আমাকে দেওয়ার মতো সময় তোমার নেই!” তাইতো তার উপলব্ধি সুন্দর মুখ মানুষকে সর্বদাই বঞ্চিত করে।

একসময় ভালো চাকরি ছিল, মন দিয়ে চাকরি করতে না পারাতে, বস একদিন বললেন, *”তপু, তুমি খুব ক্রিয়েটিভ, কিন্তু অফিসে ঘুমাও বেশি! তোমার মত ক্রিয়েটিভ মানুষ যে আমার চলবে না। আমার দরকার কাজের মানুষ। ভালো চাকরি ছিল, ঘরের সুন্দরী স্ত্রী ছিল, ফুটফুটে চাঁদমুখো কন্যা ছিল। আজ আর কিছু নেই।

চাকরি চলে যাওয়ার পর ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে দোকান খুললেন। কিন্তু দোকান ভালো চলল না। অবশেষে নানান চিন্তায় স্ট্রোক করে বসলেন। একেবারে মৃত্যুর দুয়ার তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। জীবন ও মৃত তার কাছে দুটোই সমান। এখন এই গোধূলি লগ্নে এসে শুধুই মনে পড়ে কিশোর বেলার সেই স্মৃতি। তবুও তার কোন আক্ষেপ নেই। সে চলে তার মত করে। নিজের মেয়ের মুখটা ছুয়ে দেখতে পারেনি। এই কষ্ট তাকে আর পীড়া দেয় ভীষণভাবে। একদিন সে জানতে পারে, প্রথম পক্ষের মেয়ে বিয়ে করে চলে গেল। শুধু একবার এসেছে”বাবা, তোমাকে শেষবার দেখতে এসেছি! বাবার কোন স্মৃতি তার তেমন মনে পড়ে না এখন তপুর একমাত্র সঙ্গী—সিগারেট। দিনে প্যাকেট, রাতে আরও প্যাকেট। “এটাই আমার শেষ সান্ত্বনা!”

একদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে, তপু আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। নার্স জিজ্ঞেস করল, “কি হাসছেন?” তপু উত্তর দিলেন— “ভাগ্য আমাকে এত কিছু শিখিয়েছে! চাকরি দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে। প্রেম দিয়েছে, ভাঙিয়েছে। স্ত্রী দিয়েছে, ছেড়ে গেছে। এখন শুধু সিগারেটই আমাকে ছাড়ে নি… হে আল্লাহ, আমাকে তুমি সিগারেটখোর থেকে বিড়িখোর বানিও না!” এটাই আমার শেষ ইচ্ছা ”

হাসপাতালের সাদা চাদরে মোড়া তপু আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসল। জানালার গ্রিলে বসা চড়াই পাখিটা হয়তো তার যৌবনের কোনো কবিতার লাইন মনে পড়িয়ে দিল। নার্সের চোখে জল এসে গেল – সে জানত না এই হাসি কি কিশোর তপুর প্রথম প্রেমের স্মৃতি, না মধ্যবয়সের ব্যর্থতার বিদ্রূপ, না মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ উপলব্ধি… শুধু জানত, আজ রাতের ডিউটিতে আবার এই রুমেই হয়তো সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।”

Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ

রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান:  অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন

অদৃষ্টের হাসি

আপডেট টাইম : ০৯:০১:৫৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

অদৃষ্টের হাসি

তপু রায়হান—নামটা শুনলেই মনে হয় কোনো নায়কের গল্প শুরু হবে। লম্বা-চওড়া, ছিপছিপে গড়ন, পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির দীর্ঘদেহ, চোখ দুটো যেন কালো জলের ফোয়ারা। প্রথম দেখায় যে কোনো নারীর চোখ আটকে যেত তার দিকে। কিন্তু এখন? বয়স পঞ্চাশ, চুলে পাক ধরা, চোখের নিচে কালি, আর জীবনের সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার।

কৈশোরে নিরবে প্রেম এসেছিল একদিন। মেয়েটা প্রায়ই তাকে দেখে হাসত। তপু লাজুক স্বভাবে জিজ্ঞেস করত, “কেমন আছো তুমি? তোমার হাসিতে মনে হয়, প্রেম না দিলেও চলবে—শুধু হাসিই যথেষ্ট।” মেয়েটি মিষ্টি সুরে বলত, “ঘিন্না লাগে!” তপু হেসে উত্তর দিত, “এতদিন ধরে তোমার হাসি দেখছি, কিন্তু আমার ঘেন্না তো শেষ হয় না। আমি আর কতকাল ঘেন্নার পাত্র হয়ে থাকব?” ওই হাসিই ছিল তার প্রথম অঙ্কুরিত ভালোবাসা—যা কখনো ফুল হয়ে ফুটতে পায়নি।

তপুর জীবনে এসেছে অনেক মেয়ে। সবাই বলেছে, “তুমি খুব ভালো মানুষ!” কিন্তু কেউ বলে নি, “তুমি খুব ভালো প্রেমিক!” প্রথম প্রেমিকা তাকে শুধু বন্ধু ভাবত, প্রেমিক নয়। তবুও তপু প্রথাগত ভালোবাসায় ডুবে ছিল, আর সেই বিরহে বেছে নিয়েছিল নিঃসঙ্গতা। এভাবেই তার সাথে বন্ধুত্বের ছাড়াছাড়ি হয়। এই বিচ্ছেদেই তাকে নেশার জগতে টেনে আনে। এরপরও আরেকজনকে ভালোবাসত, কিন্তু বিয়ে করল অন্যকে। কারণ, হিসাবে মেয়েটি বলল”তুমি খুব ইমোশনাল, সংসারের ভার নিতে পারবে না!” শেষে বিয়ে করেছিলেন সুন্দরী এক মেয়েকে। কিন্তু তিন বছর পরেই সে চলে গেল। বলেছিল, *”তুমি শুধু গান শুনে আর কবিতা লিখে সময় কাটাও। আমাকে দেওয়ার মতো সময় তোমার নেই!” তাইতো তার উপলব্ধি সুন্দর মুখ মানুষকে সর্বদাই বঞ্চিত করে।

একসময় ভালো চাকরি ছিল, মন দিয়ে চাকরি করতে না পারাতে, বস একদিন বললেন, *”তপু, তুমি খুব ক্রিয়েটিভ, কিন্তু অফিসে ঘুমাও বেশি! তোমার মত ক্রিয়েটিভ মানুষ যে আমার চলবে না। আমার দরকার কাজের মানুষ। ভালো চাকরি ছিল, ঘরের সুন্দরী স্ত্রী ছিল, ফুটফুটে চাঁদমুখো কন্যা ছিল। আজ আর কিছু নেই।

চাকরি চলে যাওয়ার পর ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে দোকান খুললেন। কিন্তু দোকান ভালো চলল না। অবশেষে নানান চিন্তায় স্ট্রোক করে বসলেন। একেবারে মৃত্যুর দুয়ার তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। জীবন ও মৃত তার কাছে দুটোই সমান। এখন এই গোধূলি লগ্নে এসে শুধুই মনে পড়ে কিশোর বেলার সেই স্মৃতি। তবুও তার কোন আক্ষেপ নেই। সে চলে তার মত করে। নিজের মেয়ের মুখটা ছুয়ে দেখতে পারেনি। এই কষ্ট তাকে আর পীড়া দেয় ভীষণভাবে। একদিন সে জানতে পারে, প্রথম পক্ষের মেয়ে বিয়ে করে চলে গেল। শুধু একবার এসেছে”বাবা, তোমাকে শেষবার দেখতে এসেছি! বাবার কোন স্মৃতি তার তেমন মনে পড়ে না এখন তপুর একমাত্র সঙ্গী—সিগারেট। দিনে প্যাকেট, রাতে আরও প্যাকেট। “এটাই আমার শেষ সান্ত্বনা!”

একদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে, তপু আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। নার্স জিজ্ঞেস করল, “কি হাসছেন?” তপু উত্তর দিলেন— “ভাগ্য আমাকে এত কিছু শিখিয়েছে! চাকরি দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে। প্রেম দিয়েছে, ভাঙিয়েছে। স্ত্রী দিয়েছে, ছেড়ে গেছে। এখন শুধু সিগারেটই আমাকে ছাড়ে নি… হে আল্লাহ, আমাকে তুমি সিগারেটখোর থেকে বিড়িখোর বানিও না!” এটাই আমার শেষ ইচ্ছা ”

হাসপাতালের সাদা চাদরে মোড়া তপু আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসল। জানালার গ্রিলে বসা চড়াই পাখিটা হয়তো তার যৌবনের কোনো কবিতার লাইন মনে পড়িয়ে দিল। নার্সের চোখে জল এসে গেল – সে জানত না এই হাসি কি কিশোর তপুর প্রথম প্রেমের স্মৃতি, না মধ্যবয়সের ব্যর্থতার বিদ্রূপ, না মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ উপলব্ধি… শুধু জানত, আজ রাতের ডিউটিতে আবার এই রুমেই হয়তো সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।”