ঢাকা ০৯:১৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম
রাজশাহী সেটেলমেন্ট অফিসে প্রতিটি ধাপে দুর্নীতিসহ করা হচ্ছে দুর্বিসহ হয়রানী ২০ বছর পর রায়: খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দুইজনকে হত্যায় ৪ জনের যাবজ্জীবন পুলিশের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত  প্রশিক্ষণ কোর্স এর উদ্বোধন করলেন এসপি সাফিউল সারোয়ার দিনাজপুরের কৃতি সন্তান রোকমুনুর জামান রনি আবারও বেসিস সহায়ক কমিটিতে নির্বাচিত পদ্মার চরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ৩, গুলিবিদ্ধ ২ যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে তার পক্ষে কাজ করতে হবে, তারেক রহমান আবারো ভালো কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কারে ভূষিত হলেন ওসি শাহিন রেজা  মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই–ইউএনও আরিফুজ্জামান  ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ফেস্টিভ্যালে ইংরেজি বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন সরকারি বালিকা বিদ্যালয় লালপুরে নারীর জাগরণ মঞ্চ করলেন- পুতুল

রাজশাহী সেটেলমেন্ট অফিসে প্রতিটি ধাপে দুর্নীতিসহ করা হচ্ছে দুর্বিসহ হয়রানী

রাজশাহী সেটেলমেন্ট অফিসে প্রতিটি ধাপে দুর্নীতিসহ করা হচ্ছে দুর্বিসহ হয়রানী

রাজশাহী ব্যুরো:
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঘোড়া পাখিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুস সামাদসহ একাধিক ভুক্তভোগী তাদের পৈত্রিক জমি উদ্ধারের আশায় রাজশাহী সেটেলমেন্ট অফিসে ছুট এসেছেন। নদীগর্ভে বিলীন হওয়া জমি ও বিএস রেকর্ডের জটিলতায় বিপাকে পড়েছেন তারা। কেউ জমি হারিয়েছেন নদীতে, আবার কারও জমি ভুলভাবে অন্যের খতিয়ানে চলে গেছে, আবার কারো নকশার সমস্যা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিএস রেকর্ডে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে পরবর্তীতে সংশোধনের নামে সাধারণ মানুষের থেকে অনৈতিক সুবিধা নিতে পারে। এর জন্য ওতপেতে রয়েছে দালালচক্র ও কিছু অসাধু কর্মচারী।

রাজশাহী সেটেলমেন্ট অফিসের দিয়ারা শাখায় গিয়ে দেখা যায়, রেকর্ড কিপারের কক্ষের সামনে একটি বেঞ্চ পেতে বসে রয়েছে অসংখ্য মানুষ। জানলাম তাদের হয়রানীর কথা। ভুক্তভোগীরা জানান, তারা সুদুর চাপাই নবাবগঞ্জ থেকে এসেছেন। তারা বছরের পর বছর ধরনা দিচ্ছেন জমি সমস্যা সমাধানের জন্য। এসময় কথা হয়
চাপাই নবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঘোড়াপাখিয়া এলাকার কৃষক আব্দুস সামাদের সাথে। তিনি জানান, বাপ-দাদার পৈত্রিক জমি বন্যায় নদীগর্ভে চলে গেছে। কিন্তু তারা সেই জমিতে এখনও ফসল আবাদ করছে। এখন সেই জমির খাজনা সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। অর্থাৎ সরকার জমিগুলো নিয়ে নিয়েছে (সিকুস্তি করেছে)। জমি উদ্ধারের জন্য রাজশাহী সেটেলমেন্ট অফিসে ২ বছর ধরে ঘুরছেন, কিন্তু টাকা ছাড়া একটি কাজও কেউ করছেনা, এমনটায় জানালেন তিনি।

আরেকজন ভুক্তভোগী সফিকুল বলেন, জমি ফেরত পেতে হলে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে বলে তাদের বলা হয়েছে। এই মামলার করার জন্য ধাপে ধাপে টাকা নিয়েছে। কিন্তু কোন কাজের কাজ কিছু হয়নি। মামলা করার জন্য কে টাকা নিয়েছে? জানতে চাইলে তারা সবাই কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও পরে তারা মুখ খোলেন। সেটেলমেন্ট অফিসের একজন্য মহিলাকে তারা টাকা দিয়েছেন। অথচ তাদের সাথে প্রতারনা করা হয়েছে, মামলার নামে ভুয়া চিরকুট বা রশিদ দিয়েছে। সেই মহিলা এলপিআরে (অবসরে) যাওয়ার কারনে এবার তারা এসেছেন রেকর্ড কিপার আনোয়ার হোসেনের কাছে। তিনি তাদের জমি ফিরিয়ে দিবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। এই জন্য মোটা অংকের টাকা সংঙ্গে আনতে বলেছেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, টাকা নেওয়া সেই মহিলার নাম মেহের নিগার। তিনি সেখানকার পিয়ন/অফিস সহায়ক ছিলেন। বর্তমানে তিনি এলপিআর (অবসর) রয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, উক্ত নারীসহ অফিসের আরও কয়েকজন কর্মচারীর সহায়তায় মামলার নামে ভুয়া টোকেন ধরিয়ে অর্থ আদায় করেছে। অফিস ঘুরে দেখা গেছে, অফিসের বিভিন্ন অংশে দালালদের আনাগোনা। কেউ দাবি করছেন মামলা করে দেব, কেউ বলেন নামজারি ঠিক করে দেব। কিন্তু সব হবে টাকার বিনিময়ে।
ভুক্তভোগীদের একাংশ জানান, এখানে সার্ভেয়ার থেকে শুরু করে সবাই নিজের নিজের ক্লায়েন্ট (খদ্দের) নিয়ে ব্যস্ত। এখানে কাজ পেতে হলে টাকার বিকল্প নাই।

এ বিষয়ে সেখানকার চার্জ অফিসার সুজন কান্তি দাস এর সাথে কথা বলতে গেলে জানা গেল তিনি অফিস করেন না। কারন এই সুজন কান্তি দেশের বিভিন্ন সেটেলমেন্ট অফিসের দ্বায়িত্ব একাই পালন করেন। তিনি অফিসিয়াল কাজ করে থাকেন সুবিধা দেওয়া মানুষের বাসায় বাসায়। পরে কথা হয় প্রধান সহকারী মাহমুদুল আলমের সাথে। প্রাথমিকভাবে তিনি অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেন। কিন্তু প্রমাণ দেখালে তিনি বলেন, ভুক্তভোগীদের পাঠান আমি নিজেই করে দিচ্ছি। কোনো টাকা লাগবে না।

বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ১৬১ ও ১৬২ অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা যদি দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে অর্থ বা সুবিধা গ্রহণ করেন, তা ঘুষ ও দুর্নীতির অপরাধ। এ অপরাধে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রয়েছে।
এছাড়া, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ধারা ২(ডি) অনুযায়ী, সরকারি দায়িত্ব পালনে অনৈতিক সুবিধা দাবি বা গ্রহণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ, যা তদন্ত ও আইনি পদক্ষেপের আওতায় আনা যায়।

তবে সেটেলমেন্ট অফিসের দুর্নীতির ব্যাপারে চরম অসন্তোস প্রকাশ করেছেন দেশের নাগরিক সমাজ। তারা মনে করছেন, এ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি শুধু ভুক্তভোগীদের আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং প্রশাসনিক বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। সরকার যদি দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় না আনে, তাহলে সেটেলমেন্ট অফিসের প্রতি জনগণের আস্থা পুরোপুরি হারাবে। সেটেলমেন্ট প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল সেবা চালু করতে হবে, যেন কেউ ঘুষ বা দালালের ফাঁদে না পড়ে। এছাড়াও ভুল রেকর্ড সংশোধন করে সেটেলমেন্ট অফিস দালাল দৌরাত্ম কমাতে হবে।

Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ

রাজশাহী সেটেলমেন্ট অফিসে প্রতিটি ধাপে দুর্নীতিসহ করা হচ্ছে দুর্বিসহ হয়রানী

রাজশাহী সেটেলমেন্ট অফিসে প্রতিটি ধাপে দুর্নীতিসহ করা হচ্ছে দুর্বিসহ হয়রানী

আপডেট টাইম : ০৯:১৫:৩৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

রাজশাহী সেটেলমেন্ট অফিসে প্রতিটি ধাপে দুর্নীতিসহ করা হচ্ছে দুর্বিসহ হয়রানী

রাজশাহী ব্যুরো:
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঘোড়া পাখিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুস সামাদসহ একাধিক ভুক্তভোগী তাদের পৈত্রিক জমি উদ্ধারের আশায় রাজশাহী সেটেলমেন্ট অফিসে ছুট এসেছেন। নদীগর্ভে বিলীন হওয়া জমি ও বিএস রেকর্ডের জটিলতায় বিপাকে পড়েছেন তারা। কেউ জমি হারিয়েছেন নদীতে, আবার কারও জমি ভুলভাবে অন্যের খতিয়ানে চলে গেছে, আবার কারো নকশার সমস্যা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিএস রেকর্ডে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে পরবর্তীতে সংশোধনের নামে সাধারণ মানুষের থেকে অনৈতিক সুবিধা নিতে পারে। এর জন্য ওতপেতে রয়েছে দালালচক্র ও কিছু অসাধু কর্মচারী।

রাজশাহী সেটেলমেন্ট অফিসের দিয়ারা শাখায় গিয়ে দেখা যায়, রেকর্ড কিপারের কক্ষের সামনে একটি বেঞ্চ পেতে বসে রয়েছে অসংখ্য মানুষ। জানলাম তাদের হয়রানীর কথা। ভুক্তভোগীরা জানান, তারা সুদুর চাপাই নবাবগঞ্জ থেকে এসেছেন। তারা বছরের পর বছর ধরনা দিচ্ছেন জমি সমস্যা সমাধানের জন্য। এসময় কথা হয়
চাপাই নবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঘোড়াপাখিয়া এলাকার কৃষক আব্দুস সামাদের সাথে। তিনি জানান, বাপ-দাদার পৈত্রিক জমি বন্যায় নদীগর্ভে চলে গেছে। কিন্তু তারা সেই জমিতে এখনও ফসল আবাদ করছে। এখন সেই জমির খাজনা সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। অর্থাৎ সরকার জমিগুলো নিয়ে নিয়েছে (সিকুস্তি করেছে)। জমি উদ্ধারের জন্য রাজশাহী সেটেলমেন্ট অফিসে ২ বছর ধরে ঘুরছেন, কিন্তু টাকা ছাড়া একটি কাজও কেউ করছেনা, এমনটায় জানালেন তিনি।

আরেকজন ভুক্তভোগী সফিকুল বলেন, জমি ফেরত পেতে হলে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে বলে তাদের বলা হয়েছে। এই মামলার করার জন্য ধাপে ধাপে টাকা নিয়েছে। কিন্তু কোন কাজের কাজ কিছু হয়নি। মামলা করার জন্য কে টাকা নিয়েছে? জানতে চাইলে তারা সবাই কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও পরে তারা মুখ খোলেন। সেটেলমেন্ট অফিসের একজন্য মহিলাকে তারা টাকা দিয়েছেন। অথচ তাদের সাথে প্রতারনা করা হয়েছে, মামলার নামে ভুয়া চিরকুট বা রশিদ দিয়েছে। সেই মহিলা এলপিআরে (অবসরে) যাওয়ার কারনে এবার তারা এসেছেন রেকর্ড কিপার আনোয়ার হোসেনের কাছে। তিনি তাদের জমি ফিরিয়ে দিবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। এই জন্য মোটা অংকের টাকা সংঙ্গে আনতে বলেছেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, টাকা নেওয়া সেই মহিলার নাম মেহের নিগার। তিনি সেখানকার পিয়ন/অফিস সহায়ক ছিলেন। বর্তমানে তিনি এলপিআর (অবসর) রয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, উক্ত নারীসহ অফিসের আরও কয়েকজন কর্মচারীর সহায়তায় মামলার নামে ভুয়া টোকেন ধরিয়ে অর্থ আদায় করেছে। অফিস ঘুরে দেখা গেছে, অফিসের বিভিন্ন অংশে দালালদের আনাগোনা। কেউ দাবি করছেন মামলা করে দেব, কেউ বলেন নামজারি ঠিক করে দেব। কিন্তু সব হবে টাকার বিনিময়ে।
ভুক্তভোগীদের একাংশ জানান, এখানে সার্ভেয়ার থেকে শুরু করে সবাই নিজের নিজের ক্লায়েন্ট (খদ্দের) নিয়ে ব্যস্ত। এখানে কাজ পেতে হলে টাকার বিকল্প নাই।

এ বিষয়ে সেখানকার চার্জ অফিসার সুজন কান্তি দাস এর সাথে কথা বলতে গেলে জানা গেল তিনি অফিস করেন না। কারন এই সুজন কান্তি দেশের বিভিন্ন সেটেলমেন্ট অফিসের দ্বায়িত্ব একাই পালন করেন। তিনি অফিসিয়াল কাজ করে থাকেন সুবিধা দেওয়া মানুষের বাসায় বাসায়। পরে কথা হয় প্রধান সহকারী মাহমুদুল আলমের সাথে। প্রাথমিকভাবে তিনি অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেন। কিন্তু প্রমাণ দেখালে তিনি বলেন, ভুক্তভোগীদের পাঠান আমি নিজেই করে দিচ্ছি। কোনো টাকা লাগবে না।

বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ১৬১ ও ১৬২ অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা যদি দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে অর্থ বা সুবিধা গ্রহণ করেন, তা ঘুষ ও দুর্নীতির অপরাধ। এ অপরাধে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রয়েছে।
এছাড়া, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ধারা ২(ডি) অনুযায়ী, সরকারি দায়িত্ব পালনে অনৈতিক সুবিধা দাবি বা গ্রহণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ, যা তদন্ত ও আইনি পদক্ষেপের আওতায় আনা যায়।

তবে সেটেলমেন্ট অফিসের দুর্নীতির ব্যাপারে চরম অসন্তোস প্রকাশ করেছেন দেশের নাগরিক সমাজ। তারা মনে করছেন, এ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি শুধু ভুক্তভোগীদের আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং প্রশাসনিক বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। সরকার যদি দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় না আনে, তাহলে সেটেলমেন্ট অফিসের প্রতি জনগণের আস্থা পুরোপুরি হারাবে। সেটেলমেন্ট প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল সেবা চালু করতে হবে, যেন কেউ ঘুষ বা দালালের ফাঁদে না পড়ে। এছাড়াও ভুল রেকর্ড সংশোধন করে সেটেলমেন্ট অফিস দালাল দৌরাত্ম কমাতে হবে।